গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
বিজেপির এক নেতা ঠাট্টা করে বলছেন, ‘টেল অব টু সিটিজ’। দুই শহরের দুই প্রাক্তন মেয়র, দু’জনেই বিজেপিতে। কিন্তু গতিবিধির নিরিখে তাঁরা প্রায় দুই মেরুতে থাকলেন মঙ্গলবার।
অমিত শাহের হাই ভোল্টেজ সভা কলকাতায়। এনআরসি নিয়ে কী বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী— সব চোখ-কান সে দিকে। কিন্তু তার ফাঁকেই চর্চায় উঠে এল দলের অন্দরমহলের জোয়ার-ভাটা। নেতৃত্বের ‘আন্তরিক আমন্ত্রণ’ পেয়েও অমিত শাহের সভায় এ দিন অনুপস্থিত থাকলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। আর জল্পনায় ইতি টেনে বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র হাজির হয়ে গেলেন শাহের মঞ্চে।
রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত যে ঘাসফুল ফেলে পদ্মফুল হাতে তুলে নিতে চলেছেন, গত তিন মাস ধরেই সে ইঙ্গিত স্পষ্ট ভাবে মিলছিল। সেই কারণেই জুলাই মাসে বিধাননগরের মেয়র পদ থেকে তাঁকে সরানোর তোড়জোড় শুরু করে তৃণমূল। সব্যসাচীও ইস্তফা দিয়ে দেন। তবে ঠিক কবে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তা স্পষ্ট ছিল না। স্পষ্ট হয় সোমবার। বিজেপি সূত্রে জানা যায়, অমিত শাহের উপস্থিতিতেই বিজেপিতে যোগ দেবেন রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল বিধায়ক। সব্যসাচী নিজেও সোমবার ঘোষণা করে দেন যে, মঙ্গলবার দলবদল করছেন।
আরও পড়ুন: কোনও হিন্দুকে ভারত ছাড়তে হবে না, এনআরসির আগে নাগরিকত্ব আইন, বলে গেলেন অমিত শাহ
এ দিন অমিত শাহ নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পৌঁছনোর কিছু ক্ষণ আগেই সব্যসাচী দত্ত সেখানে পৌঁছন। শাহের ভাষণ শুরু হওয়ার আগে তাঁকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় উত্তরীয় পরিয়ে দেন সব্যসাচীকে। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তুলে দেন দলের পতাকা। তার পরে সায়ন্তন বসু ঘোষণা করেন যে, সব্যসাচী দত্ত উত্তরীয় পরিয়ে দেবেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহকে। কিন্তু ঘটে উল্টোটাই। সব্যসাচী এগিয়ে যেতেই অমিত শাহ তাঁর হাত থেকে উত্তরীয় নিয়ে নেন এবং নিজেই পরিয়ে দেন সব্যসাচীর গলায়।
বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়রকে দলে স্বাগত জানানোর পরে তাঁকে অল্প ক্ষণের জন্য ভাষণ দেওয়ার সুযোগও এ দিন দিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। সেই ভাষণে অমিত শাহকে সব্যসাচী অনুরোধ করেন, ‘‘কাশ্মীর যেমন ঠান্ডা করেছেন, সে ভাবে বাংলাকেও এ বার ঠান্ডা করুন।’’
আরও পড়ুন: রাজীবের কাছে ‘হার’ সব দিকেই, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিবিআই
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের শিবিরে কিন্তু ছবিটা এ দিন অন্য রকম ছিল। শোভনকে এ দিন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দেখা যায়নি। ব্যক্তিগত সমস্যায় আটকে পড়ার কারণে তিনি যেতে পারেননি অমিত শাহের সভায়— দাবি শোভন ঘনিষ্ঠদের। কিন্তু শোভনের অনুপস্থিতি নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে খুব স্বাভাবিক কারণেই।
শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ১৪ অগস্ট। তার এক সপ্তাহ পরে রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে তাঁদের সংবর্ধনার আয়োজন হয়। কিন্তু সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে ঘিরে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সে দিনের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে যা রটেছিল, তেমন অনেক কিছুই ঘটেনি বলে শোভন-বৈশাখী জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য প্রণোদিত অপপ্রচারের অভিযোগ তুলেছিলেন দলেরই কয়েক জনের বিরুদ্ধে।
এতেই থেমে থাকেনি মন কষাকষি। রায়দিঘির তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ের বিজেপিতে যোগদানের সম্ভাবনাকে ঘিরেও তৈরি হয়েছিল অশান্তির মেঘ। দেবশ্রীকে বিজেপিতে নেওয়া হলে তিনি বিজেপিতে থাকবেন না বলে আগেই জানিয়েছিলেন শোভন। কিন্তু দেবশ্রীকে দলে স্বাগত জানানোর বিষয়ে রাজ্য বিজেপির একাংশ প্রকাশ্যেই আগ্রহ ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন। তা নিয়ে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে রাজ্য বিজেপির বেশ কয়েক জন নেতার বাগ্যুদ্ধ চরমে উঠেছিল।
সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য শোভন-বৈশাখীকে যে দিন ডাকা হয়েছিল রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে, সে দিনের পরে কিন্তু আর বিজেপি অফিসমুখো হননি শোভনরা। বিজেপির কোনও কর্মসূচিতেও তাঁদের দেখা যায়নি গত দেড় মাসে। দলের কার্যকরী সভাপতি জে পি নড্ডা কয়েক দিন আগেই কলকাতা সফর সেরে গিয়েছেন। নড্ডার কর্মসূচিতে শোভনরা ডাক পাননি। ফলে জল্পনা তৈরি হয় অমিত শাহের কর্মসূচিতে শোভনদের ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও।
বিজেপি সূত্রের খবর, দলের রাজ্য নেতৃত্ব কিন্তু এ বার আর কোনও ত্রুটি রাখেননি। শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে অমিত শাহের সভায় এবং সভা পরবর্তী বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বলে খবর। কোনও এক জন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, এমনও নয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁদের আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয় সোমবার। দলের রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে একাধিক বার তাঁদের ফোনও করা বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু এ দিন নেতাজি ইন্ডোরে আর শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি শোভন-বৈশাখীকে।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র কেন গেলেন না অমিত শাহের সভায়? বৈঠকেই বা যোগ দিলেন না কেন? শোভন চট্টোপাধ্যায় মুখ খুলতে চাননি বিষয়টি নিয়ে। তবে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সোমবার আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার আগে পর্যন্ত জানতাম না যে, আমন্ত্রণ আসবে। তাই আগে থেকেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ নির্ধারিত ছিল। তবু চেষ্টা করেছিলাম অমিতজির সভায় যাওয়ার। কিন্তু যেতে পারাটা যে কিছুটা অনিশ্চিত, সেটাও নেতৃত্বকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলাম।’’
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যে ব্যাখ্যাই দিন, অমিত শাহের সভায় তাঁদের অনুপস্থিতি ঘিরে রাজনৈতিক শিবিরে জল্পনা তৈরি হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই। রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্গে যে মন কষাকষি তাঁদের চলছিল, তার জেরেই কি এ দিন অমিত শাহের সভা ‘বয়কট’ করলেন শোভনরা? উঠেছে এই প্রশ্নও।
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু ‘বয়কট’ তত্ত্ব সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সর্বভারতীয় সভাপতি কলকাতায় এসেছেন। সে রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সভায় আমাদের আমন্ত্রণ জানানোয় আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁকে বয়কট করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু আমার কলেজে আজ একটা অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। আমি খুব সমস্যায় ছিলাম। আমাকে থানায় যেতে হয়েছিল। তাই আর সভায় যেতে পারিনি।’’
শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধি থেকে রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব— বিভিন্ন মহল সোমবার থেকে যোগাযোগ করেছিল প্রাক্তন মেয়রের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত শোভন যেতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু রাজ্য বিজেপির বেশ কয়েক জনের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধের জেরে বিজেপির সঙ্গে শোভনের যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা এখন অতীত বলেই শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি। বিজেপি নেতৃত্ব যে ভাবে তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাতে ‘আন্তরিকতা’ ছিল বলেই শোভন মনে করছেন। দাবি তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy