যুদ্ধের ধাক্কা বইপাড়ায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কলকাতা থেকে কিভের দূরত্ব প্রায় ছ’হাজার কিলোমিটার। পূর্ব ইউরোপের সেই শহরে রাশিয়ার হামলার প্রভাব কলকাতার বইপাড়াতেও। বইমেলা কোনও ভাবে কেটে গিয়েছে। কিন্তু সামনে নববর্ষে যে সব বই প্রকাশ হবে কিংবা পাঠ্যবই ছাপা হবে তার দামে পড়তে পারে যুদ্ধের বড় প্রভাব। কারণ, কাগজের দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক দিকে যুদ্ধের কারণে কাগজের কাঁচামালের আমদানি যেমন কমেছে তেমনই দেশে উৎপাদনও তলানিতে। আর তার জেরে প্রতিদিনই নাগালের বাইরে যাচ্ছে কাগজের দাম। সেই সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে কালি-সহ ছাপার অন্যান্য সরঞ্জামের দামও। ফলে এ বার বইয়ের দাম অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে। অনেকেই বলছেন, যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ কাগজের কালোবাজারি চালাচ্ছেন।
কাগজের কালোবাজারি চলছে বলে অভিযোগ উঠলেও সেটা মানতে রাজি নন, কলকাতায় কাগজের পাইকারি ব্যবসায়ী রাজীব ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘বিক্রেতাদের কাছে কাগজই নেই। অনেক বেশি দাম দিয়ে কিছু কিছু মাল আসছে। সেটার দামও বেশি পড়ছে। এটাকেই অনেকে কালোবাজারি মনে করছেন।’’ রাজীব জানান, বিশ্বে কাগজ উৎপাদনে রাশিয়া বড় ভূমিকা নেয়। ভারতে কাগজের মূল কাঁচামাল ‘পাল্প’ আসে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের ফলে সে দেশ থেকে পাল্প আসছে না। ভারতের অনেক কাগজকলই নিয়মিত উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক কাগজ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এক ব্যবসায়ী বলেন, ভারতে নিউজপ্রিন্ট কাগজের ৪৫ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের কারণে সেই উৎপাদন যেমন ধাক্কা খেয়েছে তেমনই রাশিয়ার বন্দরগুলিও কার্যত বন্ধ হয়ে রয়েছে। রাশিয়ার ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে লেনদেনও সে ভাবে করা যাচ্ছে না। এর উপরে কাগজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে কয়লা সবেরই অভাব রয়েছে। কাগজ তৈরিতে প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ হয় জ্বালানি বাবদ। তাই শুধু কলকাতাতেই নয়, ভারত-সহ বিশ্বের অনেক দেশেই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে কাগজ তথা মুদ্রণ শিল্পে। ওই ব্যবসায়ীর দাবি, শুধু রাশিয়া নয়, কাগজের কাঁচামাল উৎপাদনে বড় ভূমিকা নেয় ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, জার্মানি, হাঙ্গেরি-সহ ইউরোপের অনেক দেশ। সর্বত্রই পড়েছে যুদ্ধের প্রভাব।
কলকাতার প্রকাশক থেকে ছাপাখানার মালিক, সকলেই চিন্তিত। কাগজ বিক্রেতারা বলছেন, জোগান কম আর চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম বাড়ছে। ইতিকথা প্রকাশনার কর্ণধার শূদ্রক উপাধ্যায় বললেন, ‘‘কেজি প্রতি কাগজের দাম রোজ বাড়ছে। কাগজের ওজন নির্ভর করে, সেটা কতটা মোটা বা পাতলা তার হিসাবে। সেই অনুযায়ী এক রিম কাগজের ওজন ১৫ থেকে ২১ কেজি পর্যন্ত হয়। বইমেলার আগে যে কাগজ ২,৩৫০ টাকায় এক রিম কিনেছি সেটাই এখন ২,৭৫০ টাকা হয়ে গিয়েছে। ছাপাখানার পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে আগামীতে আরও বাড়তে পারে এই দাম।’’
একই কথা শোনা গেল দে’জ পাবলিশার্সের কর্ণধার শুভঙ্কর দের গলায়। তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধের প্রভাব তো আছেই, তবে তার আগে থাকতেই কাগজের দাম বেড়ে চলেছে। গত চার পাঁচ মাসের মধ্যে অনেকটা দাম বেড়েছে। এত দ্রুত আর কিছুর দাম বেশি হয়েছে কি না জানি না। লকডাউনের সময়ে যে কাগজ ১,৪০০ টাকা কিনেছি সেটা এখন ২,২০০। বই ছাপার ক্ষেত্রে বড় খরচ কাগজ। বই ছাপার কাগজ রিম প্রতি ৩৫০-৪৫০ টাকা বেড়েছে। আর প্রচ্ছদের জন্য ব্যবহৃত আর্ট পেপারে বৃদ্ধিটা ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। ফলে এখন ছাপা বইয়ের দাম বাড়বেই। কিন্তু তাতে আবার ক্রেতারা মুশকিলে পড়বেন।’’
শুধু প্রকাশকরাই নন, কাগজের দাম বেড়ে চলা নিয়ে চিন্তিত কলকাতার ছাপাখানার মালিকরাও। ডি অ্যান্ড পি গ্রাফিক্স-এর কর্ণধার অর্ক মিত্র জানান, কাঁচামালের জোগানের অভাবে দেশের অনেক কাগজের মিল উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। ফলে কমছে জোগান। অনেক দিন ধরেই কাগজের মিলগুলোর উৎপাদন কমছিল। অস্থির ছিল। যুদ্ধ লাগার পরে সেটা আরও বেড়েছে। ভারতে তৈরি কাগজ বাইরে যাওয়াও বন্ধ হয়েছে। রাশিয়ায় কাগজ যায়। অর্কর দাবি, কাগজের জোগান কম হওয়ায় কালোবাজারিও চলছে। তিনি বলেন, ‘‘এখন যে হেতু বাজারে পর্যাপ্ত কাগজ নেই, তাই দামও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। যাঁদের কাছে আগে কেনা কাগজের মজুদ রয়েছে তাঁরা যেমন খুশি দাম চাইছেন। অনেক সময়ে বাধ্য হয়ে সেটা নিতে হচ্ছে। কেজি প্রতি কাগজের দাম প্রতি দিনই ১-২ টাকা করে বেড়ে চলেছে।’’ অর্কর কথা অনুযায়ী, নিউজপ্রিন্ট, ম্যাপলিথো থেকে আর্ট পেপার সবেরই দাম বাড়ছে। কাগজের বোর্ডের দামও একই ভাবে ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে বইয়ের সার্বিক উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তিনি জানান, ইদানীং সব কিছুরই পরিবহণ খরচ বেড়েছে। এর ফলে কালি থেকে অ্যালুমিনিয়াম প্লেট, সবতেই অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy