কম্পিউটার স্ক্রিনে স্বামী। ‘ই-মুলাকাত’ নাতালিয়ার। নিজস্ব চিত্র
মাদক মামলার ফেরে তাঁর ঠিকানা এখন দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। কিন্তু মন পড়ে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে, যেখানে আছেন তাঁর স্বামী ও সন্তান। ‘গুগল মিট’ দূরত্ব ঘোচালেও সেটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর শামিল। রাতে ঘুম আসছে না বন্দিনি নাতালিয়া অ্যাপ্রেলেঙ্কোর চোখে। কারা-কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার জানতে চাইছেন, ‘ছেলে কি কোনও খবর পাঠিয়েছে? স্বামী কোনও ভাবে যোগাযোগ করেছেন কি?’
ইউক্রেনে পড়তে যাওয়া এ দেশের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই ঘরে ফিরেছেন। স্বস্তি ফিরেছে তাঁদের পরিবারে। কিন্তু প্রায় সাত বছর আগে নিষিদ্ধ মাদক নিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে ধরা পড়া বছর পঞ্চাশের নাতালিয়ার যুদ্ধ-উপদ্রুত স্বদেশে ফেরা হয়নি। নিজভূমিতে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে দুঃসময়ের প্রহর ভাগ করে নিতে পারছেন না তিনি। কিছুতেই দুশ্চিন্তা কাটছে না। কারা দফতর জানাচ্ছে, আপাতত ইউক্রেনের এই এক জন নাগরিকই এ রাজ্যের জেলে রয়েছেন।
পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ভিডিয়ো সম্মেলনে বন্দিদের কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ই-মুলাকাত’ ব্যবস্থা চালু করেছে কারা দফতর। ওই ব্যবস্থায় নাতালিয়ার সঙ্গে তাঁর ছেলে অ্যাপ্রেলেঙ্কো ভোলোদিমিরের যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন দমদম জেল কর্তৃপক্ষ। মা-ছেলের দেখা এবং কথা হচ্ছে গুগল মিটে।
কারা দফতরের তথ্য বলছে, ভোলোদিমির এবং তাঁর বাবা আলেকজ়ান্ডার থাকেন ইউক্রেন সিটিতে। সেখানে চাকরি করেন ভোলোদিমির। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে নির্দিষ্ট সময়ান্তরে তিনি কারা দফতরে আবেদন জানান ‘ন্যাশনাল প্রিজ়ন ইনফর্মেশন পোর্টাল’ মারফত। কারা দফতর
সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫ সালের শেষ দিকে কলকাতা বিমানবন্দরে নিষিদ্ধ মাদক-সহ ধরা পড়েন নাতালিয়া। তাঁর বিরুদ্ধে এনডিপিএস আইনে (নার্কোটিক ড্রাগ অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যানসেস অ্যাক্ট) মামলা চলছে। দিন পড়লে বারাসত আদালতে হাজির করানো হয় তাঁকে। ২০১৫-র ১০ ডিসেম্বর থেকেই নাতালিয়া জেলবন্দি।
জেল সূত্রের খবর, তিন নম্বর ফিমেল ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাতালিয়া বেশ মিশে গিয়েছেন সহবন্দিদের সঙ্গে। শিখেছেন বেশ কিছু বাংলা শব্দ। ছেলের সঙ্গে ভিডিয়ো-সম্মেলন চলাকালীন নতুন শেখা বাংলা শব্দ ব্যবহারও করেন। জেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বাঙালি খাবার তাঁর খুব পছন্দ। ইউক্রেনে দর্জির কাজ করতেন তিনি। পড়াশোনা করেছেন সে-দেশের সেকেন্ডারি (মাধ্যমিক) স্তর পর্যন্ত। যুদ্ধ শুরুর পরেই উদ্বেগের পারদ বাড়তে থাকে নাতালিয়ার।
এক জেল আধিকারিক বলেন, ‘‘ওই বন্দিনি বার বার আমাদের কাছে এসে জানতে চাইতেন স্বামী-সন্তানের কথা। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে ইন্টারনেট ব্যবস্থা বেহাল। আমরা অনেক কষ্টে ওঁর ছেলের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর জোগাড় করে মেসেজ পাঠাই। বেশ কিছু দিন পরে ওঁর ছেলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, ওঁরা আপাতত ভাল আছেন। এখন যে-জায়গায় রয়েছেন, সেখানে যুদ্ধ চলছে না। আমরা ওঁকে আমাদের পোর্টাল মারফত মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলি। দীর্ঘদিন স্বামী-সন্তানের খবর না-পেয়ে মনমরা হয়ে গিয়েছিলেন নাতালিয়া। তাঁরা ভাল আছেন জানতে পেরে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন।’’ তার পর থেকে নিয়ম মোতাবেক মাসে দু’বার পোর্টাল মারফত মা-ছেলের কথা বলিয়ে দেন দমদম জেলের ই-মুলাকাত প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকা আধিকারিক রামমোহন সরকার। ভোলোদিমিরকে হোয়াটসঅ্যাপে জেল-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে। এখন তাঁর মেসেজ আসে প্রায়ই।
কারা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে নাতালিয়ার সঙ্গে তাঁর ছেলের ভিডিয়ো-সম্মেলনে কথা হয়েছে ছ’বার। শেষ বার কথা হয় ৪ এপ্রিল। কারা দফতরের ‘ই-প্রিজ়ন’ প্রকল্পের নোডাল অফিসার প্রসূন মাজি বলেন, ‘‘ইউক্রেনের ওই নাগরিককে ই-মুলাকাত ব্যবস্থায় তাঁর ছেলের মুখোমুখি করিয়ে দেওয়া হয়। ওঁর দুশ্চিন্তা কাটে।’’ এডিজি (কারা) পীযূষ পাণ্ডে জানান, ‘ই-মুলাকাত প্রকল্প বেশ সাড়া ফেলেছে। উপকৃত হচ্ছেন বহু বন্দি এবং তাঁদের পরিবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy