Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
TMC

‘ফুলদানিরা’ প্রথম সারিতে, আন্দোলনের লোক কোথায়? আরজি কর-কাণ্ডে সমাজের ক্ষোভ সংক্রমিত তৃণমূলেও

আরজি কর-কাণ্ডে তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরের ‘দূরত্ব’, ‘অবনিবনা’, ‘দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক’-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শাসকদলের মধ্যে জল্পনা, উৎকণ্ঠা রয়েছে। তার মধ্যেই যোগ হয়েছে মাঝারি স্তরের একাংশের নেতার ক্ষোভ।

RG Kar Hospital Incident: Society\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s churning is spilling over into TMC too

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৪ ১৬:২৬
Share: Save:

হুগলির সাংসদ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় কি জানেন কী ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট আঙাড়িয়ায় পৌঁছেছিলেন? বরাহনগরের বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কি জানা রয়েছে, লালু আলম-বাদশা আলম কারা? মেদিনীপুরের সাংসদ জুন মালিয়া কি কখনও জানার চেষ্টা করবেন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে কত বাধা ডিঙোতে হয়েছিল?

আরজি কর-কাণ্ডের পর পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে চলে যেতে বসেছে, তখন তৃণমূলের মাঝারি স্তর এবং নিচুতলা থেকে এ সব প্রশ্নই উঠতে শুরু করেছে। যা দেখে অনেকেই বলছেন, আরজি কর আবহে সার্বিক ভাবে সমাজের মধ্যে যে ক্রোধ তৈরি হয়েছে, তজ্জনিত উচাটন সংক্রামিত হয়েছে তৃণমূলের অন্দরেও। মাঝারি স্তরের নেতাদের অনেকেরই প্রশ্ন, ‘ফুলদানিরা’ই কি দলে সব হয়ে যেতে বসেছে? দীর্ঘ দিন ধরে যাঁরা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন, তাঁরা কই? যাঁরা ঝানু রাজনীতিক, তাঁরা কই? তাঁদের কেন পিছনে ঠেলে রাখা হচ্ছে? এক মাঝারি স্তরের নেতার কথায়, ‘‘ফুলদানিরাই সব? বাকিরা কি শুধু চেয়ার মুছবে?’’

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক বিধায়কের কথায়, ‘‘আমি এখনও বিশ্বাস করি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেয়ে মানুষের নাড়ির টান কেউ ভাল বোঝেন না। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস দেখে খুবই বিরক্ত লাগছে। দিদির বোঝা উচিত, দল এখন যে সঙ্কটের মুখোমুখি, সেখানে গ্ল্যামার কুইনদের সামনে এনে কিছু হবে না।’’ তৃণমূলের মাঝারিতলার অনেক নেতারই বক্তব্য, দলের যে ভাবে নামা উচিত, তা হচ্ছে না। যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তাতে প্রলেপ পড়ার বদলে নুনের ছিটের মতো কাজ করছে ‘সেলিব্রিটি নেত্রী’দের মন্তব্য। যা দলকে আরও জনবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।

প্রসঙ্গত, দেব বা সায়নী ঘোষ মন্তব্য প্রকাশে নিজেদের ‘সংযত’ রেখেছেন বলেও দলের অন্দরে অভিমত তৈরি হয়েছে। দেব নিজের নতুন ছবির ‘টিজ়ার’ মুক্তি স্থগিত করেছেন। সায়নী মিছিলে হাঁটা ছাড়া সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। কোথাও কোনও লম্বা-চওড়া কথা বলার চেষ্টা করেননি।

বস্তুত, দলের অন্দরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এক শ্রেণির আমলাকে নিয়েও। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘এঁরা না লাগেন হোমে, না লাগেন যজ্ঞে! এঁদের দফতরে কী কাজ হচ্ছে বা হচ্ছে না, তার খতিয়ান কেউ নেন না। দিনের পর দিন ফাইল পড়ে থাকে। আর সরকারি কাজ আটকে থাকে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে দ্রুত সরকারকে কিছু কাজ দেখাতে হবে। এমন কাজ করতে হবে, যা মানুষ দেখতে পান। যেমন রাস্তা, যেমন পানীয় জল, যেমন আলো। কিন্তু কিছু অফিসারের সে দিকে কোনও হুঁশ নেই। ফলে সরকারের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়ছে।’’

তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের বড় অংশ মনে করছেন, আরজি কর-কাণ্ড যে গণক্ষোভ তৈরি করেছে, যে ভাবে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে তা উগরে দিচ্ছেন, মমতার ১৩ বছরের শাসনকালে সেই চিত্র দেখা যায়নি। তবে এর উল্টো মতও রয়েছে। সেই অংশের বক্তব্য, যে আন্দোলন দেখা যাচ্ছে, তা সবটাই শহর এবং মফস্‌সলে। গ্রামাঞ্চলে এর কোনও প্রভাব নেই। যা দলের জন্য ‘ইতিবাচক’। প্রয়োজনের সময় গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলা যাবে। তেমনই এক নেতার কথায়, ‘‘গত ১৪-১৫ অগস্টের মাঝরাতে যে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। নাগরিক ক্ষোভের মাঝে রাজনৈতিক দখলদারি নিয়ে বিভাজনও তৈরি হয়ে গিয়েছে। এক দিকে বিজেপি, অন্য দিকে সিপিএম ময়দানে নামছে। তা দলহীন মানুষের আন্দোলনের পরিসরকে ক্রমশ সঙ্কুচিত করছে।’’ তবে গ্রামাঞ্চলের অনেক নেতা এ-ও বলছেন যে, তাঁদের এলাকায় দলে দলে লোক হয়তো রাস্তায় বেরিয়ে পড়েননি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ‘ক্ষোভ’ নেই। পৃথক কোনও বিষয় নিয়ে গ্রামাঞ্চলেও তা চাগাড় দিতে পারে, সেই আশঙ্কাও তাঁদের রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতেই ‘তারকা’ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে দলের অন্দরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ‘রাজনৈতিক বোধ’ না থাকায় তারকা থেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ারা যে ভূমিকা নিচ্ছেন, যা যা মন্তব্য করছেন, সে সব দলের পক্ষে ভাল হচ্ছে না। তৃণমূলের একাধিক নেতা কলকাতায় গত ১৬ অগস্ট মমতার মিছিলে সামনের সারিতে যে ‘তারকা রাজনীতিকেরা’ ছিলেন, তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কলকাতার এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘সায়ন্তিকা গিটার বাজিয়ে ধর্ষকের ফাঁসি চাইবেন। প্রচারের আলো শুষে নেবেন। আর আমাদের এলাকায় গিয়ে মানুষের কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে? এটা তো চলতে পারে না।’’

এমনিতেই আরজি কর আবহে তৃণমূলের সর্বোচ্চ স্তরের ‘দূরত্ব’, ‘অবনিবনা’, ‘দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক’-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শাসকদলের মধ্যে জল্পনা, উৎকণ্ঠা রয়েছে। তার মধ্যেই যোগ হয়েছে মাঝারি স্তরের একাংশের নেতার ক্ষোভ। তাঁদের বক্তব্য, যে ভাবে এই পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে কোনও দিশা দেখা যাচ্ছে না। এক নেতার বক্তব্য, ‘‘দিদি নিজে রাস্তায় নামার পরে দলকে ব্লকে ব্লকে রাস্তায় নামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেলায় জেলায় খোঁজ নিলে দেখা যাচ্ছে, সে সব কর্মসূচি হয়েছে নাম-কা-ওয়াস্তে। তাতে কোনও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। উল্টো দিকে রচনার মন্তব্য, সায়ন্তিকার গিটার বাজানোর আদিখ্যেতায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করার চেয়ে ‘ফুলদানি’ সামলাতেই সময় চলে যাচ্ছে।’’

মমতার ঘোষিত ধর্না এবং মিছিলের কর্মসূচি ছাড়া তৃণমূলকে ‘সংগঠিত’ ভাবে পথে নেমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূল যে আখ্যান তৈরি করতে চাইছে, তার বেশির ভাগটাই সমাজ এবং সংবাদমাধ্যমে। ফাঁকা থেকে যাচ্ছে রাস্তা। দলের অনেকের বক্তব্য, ছাত্র-যুব সংগঠনগুলির যে ভূমিকা নেওয়া উচিত, তা-ও তারা নিতে পারছে না মাঠে-ময়দানে। দলের এক সাংসদের বক্তব্য, আরজি কর আবহে দল যখন নানা কারণে ‘চাপে’, তখন সাংগঠনিক দিশাহীনতা প্রকট হচ্ছে। ‘ফুলদানি’দের সামনের সারিতে চলে আসার ঘটনা পরীক্ষিত সংগঠকদেরও বিড়ম্বিত করছে। তাঁর কথায়, ‘‘যে নজিরবিহীন পরিস্থিতির মুখোমুখি দলকে হতে হয়েছে, তার মোকাবিলা করতে গেলে প্রশাসন এবং সংগঠনের সমান্তরাল ভাবে চলা উচিত। সেই মৌলিক জায়গাটাতেই ফাঁক থেকে যাচ্ছে। ফুলদানি বাড়িতেই ভাল। রাস্তায় সাজিয়ে রাখলে মানুষের পায়ে চাপে ফুল আর ফুলদানি দুটোরই বারোটা বাজবে!’’

‘ফুল’ বলতে কি তিনি ‘জোড়াফুল’ বোঝাচ্ছেন? জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন সাংসদ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy