আটতলার ঘরেও সন্দেহ

আর জি করের জরুরি বিভাগ বিল্ডিংয়ের চারতলায় বক্ষরোগ বিভাগের সেমিনার কক্ষই কি তরুণী চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের ঘটনাস্থল? এই প্রশ্নের মধ্যেই সন্দেহ তৈরি হয়েছিল ওই বিল্ডিংয়ের আটতলায় অস্থি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারকে ঘিরে। কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির (সিএফএসএল) রিপোর্টে সেমিনার কক্ষে কোনও রকমের ধস্তাধস্তির চিহ্ন না মেলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই সেই সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে। যদিও আশ্চর্যজনক ভাবে আটতলার ওই অপারেশন থিয়েটার সিবিআই পরীক্ষাই করেনি। কিন্তু কেন?

নির্যাতিতার পরিবার থেকে শুরু করে আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা অনেকেই বলছেন, ‘‘এই রকম অসংখ্য ‘কেন’-র উত্তর খোঁজার চেষ্টা সিবিআইয়ের করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সিএফএসএল-এর রিপোর্টের নিরিখে পুলিশের সিজ়ার লিস্টেও বেশ কিছু অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। সেটারও কারণ স্পষ্ট হচ্ছে না।’’ তাঁদের আরও দাবি, ‘‘সাধারণ ভাবেই বোঝা যাচ্ছে, অনেক কিছুই পরিকল্পিত বা সাজানো হয়েছে।’’ আর জি কর মামলার তদন্তে কলকাতা পুলিশ ও সিবিআইয়ের বিভিন্ন গাফিলতির দিক শিয়ালদহ আদালতের রায়েও উল্লেখ রয়েছে। তেমনই তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুন ও ধর্ষণ মামলার তদন্তে এখনও রহস্যেই থেকে গিয়েছে আটতলার অপারেশন থিয়েটারের ভিতরের একটি ঘর। যা এখনও সিল করা অবস্থায় রয়েছে।

সূত্রের খবর, ৯ অগস্টের ঘটনার দিন-কয়েক পরে অস্থি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) ভিতরের ওই ঘরে গিয়েছিলেন হাসপাতালের কয়েক জন কর্মী। কারণ সেখানে আর্থ্রোস্কোপি যন্ত্র-সহ আরও কিছু জিনিস রয়েছে। সেই সময়েই ওই কর্মীরা দেখেছিলেন, ঘরের এক কোণে কিছু গ্লাভস পড়ে রয়েছে। তাতে রক্তের মতো লালচে ছাপ রয়েছে। বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত ব্লেডও পড়ে আছে। বিষয়টি জেনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও কর্তব্যরত সিআইএসএফ জওয়ানেরাও গিয়ে ঘরটি দেখেন। তাঁরা দেওয়ালেও রক্তের ছোপ দেখতে পেয়েছিলেন। সূত্রের খবর, এর পরেই আর জি কর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সিবিআইকে জানালে, তারা মৌখিক ভাবে ওই ঘরটি সিল করে রাখতে বলে এবং পরে সেটি পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে জানায়। আরও জানা যাচ্ছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর জমা পড়া ‘সিএফএসএল’-এর রিপোর্ট মাসখানেক আগে প্রকাশ্যে আসার পরেই ওই ঘরটির সিল কেউ বা কারা খোলার চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ। কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকেরা বিষয়টিতে আপত্তি তুলতেই তা আটকে যায়। আরওজানা যাচ্ছে, দিন কয়েক আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে আবারও ওই ঘরের বিষয়ে চিঠি পাঠানো হলেও, তা সিবিআই গ্রহণ করেনি। এখানেই আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের প্রশ্ন, ‘‘কেন ওই ঘর ‘সিএফএসএল’-কে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়নি? চারতলার বক্ষ রোগ বিভাগের নার্সিং স্টেশনের পিছনের দিকে যে লিফট আছে, তার সাহায্যে ওই আটতলাতেও যাতায়াতকরা যায়।’’

এমন ধরনের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা উঠে আসছে তরুণী চিকিৎসক খুন ও ধর্ষণের তদন্তে। যেমন, কলকাতা পুলিশ সিজ়ার লিস্টের ১৩ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ করেছিল, সাদা রঙের একটি খামে কালো রঙের চুল মিলেছে। যা সেমিনারকক্ষের ম্যাট্রেসের উপর, মৃতদেহের পাশ থেকে মিলেছে। একই ভাবে, সিজ়ার লিস্টের ১৫ নম্বর পয়েন্টে পুলিশ লিখেছিল, কালো ও নীল রঙের একটি ইয়ারফোন মিলেছে তরুণী চিকিৎসকের দেহ যেম্যাট্রেসের উপরে ছিল, তার নীচ থেকে। আবার, ঘটনার পরে রাজ্য ফরেন্সিক দলের প্রতিনিধিরা দাবি করেছিলেন, মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়ার পরে তাঁর পিঠের তলা থেকে চশমার ভাঙা কাচের অংশ উদ্ধারহয়েছে। কিন্তু যেখানে ধস্তাধস্তির চিহ্নই নেই, সেখানে ম্যাট্রেসের নীচে ইয়ারফোন বা চশমার ভাঙা কাচ কী আসতে যেতে পারে? ২৭ নম্বরপয়েন্টে এক জোড়া পুরনো ধূসর ও কমলা রঙের জুতো (তরুণী চিকিৎসকের) বাজেয়াপ্তের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ‘সিএফএসএল’-এর কাছে যে সমস্ত নমুনা গিয়েছিল তাতে শুধু কালো কমলা রঙের এক জোড়া চটি (যাতে লালচে ছোপ ছিল)পাঠানো হয়েছিল।

এমনই বিভিন্ন অসঙ্গতি তদন্তের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করছেন আন্দোলনকারী চিকিৎসক থেকে নির্যাতিতার পরিবারও। তরুণী চিকিৎসকের বাবার কথায়,‘‘সিবিআই আগে বলেছিল, আটতলার ঘর বন্ধ করে রাখুন। এখন বলছে খুলে দেওয়া যেতে পারে। এমন আচরণের কারণ কী? কেন সন্দেহজনকঘরটি তদন্তের বাইরে থাকবে?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আসলে সঞ্জয় রায়কে একমাত্র অপরাধী ধরে নিয়েছে সিবিআই। তাই ইচ্ছাকৃত ভাবে এমনই বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলি তদন্ত করে দেখছে না।’’ আন্দোলনকারী চিকিৎসকদেরও প্রশ্ন, ‘‘সিএসএফএল’ যেখানে বলছে, সেমিনার কক্ষে ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই, সেখানে ম্যাট্রেসের তলা থেকে ওই সব জিনিস উদ্ধার হওয়াটা কিপরিকল্পিত নয়?’’