জাহিদিন শেখের পরিবার।—নিজস্ব চিত্র
রাত নেমেছে জাতীয় সড়কে। হেড লাইট জ্বালিয়ে পরপর থমকে রয়েছে বেশ কয়েকটা গাড়ি। মাঠ-পোকার উচ্ছ্বল হুটোপুটি চুঁইয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়া সেই আলোয় টলোমলো পায়ে ফুটবল খেলছে জনা কয়েক গ্রামবাসী।
ভুল বললাম, বল নয়, রক্ত ভেজা দু’টো ছিন্ন মুণ্ডু, যা নিয়ে এ-ওর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা।
সাঁইত্রিশ বছর আগে, অগ্রহায়ণের রাতে সেই ‘আদিম ফুটবল’ দেখেছিলেন যাঁরা তাঁদের এক জন পিয়ার আলি, (নাম পরিবর্তিত) এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছেন—‘‘বাসের স্টিয়ারিং ধরে বসে আছি। ওই শীতেও হাত ঘেমে গিয়েছে। অথচ একটা কথা বলতে পারিনি। আমার উইন্ডস্ক্রিনের সামনেই ঝকঝক করছিল রক্ত ভেজা টাঙিটা।’’
মাস কয়েকের মধ্যে একটা ‘পাল্টা’ খেলাও হয়েছিল—সেই রাতের আঁধার, সেই জোড়া মুণ্ডু নিয়ে ‘ফুটবল’, সেই উল্লাস শুধু বদলে গিয়েছিল রাস্তাটা, জাতীয় সড়কের বদলে সে রাতে ছিন্ন মুণ্ডু গড়িয়ে গিয়েছিল ধুলোমাখা গ্রামীণ পথে।
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে এই আদিম ফুটবল, আর তার পাল্টা, গ্রামীণ পথে ফুটবলের নেপথ্যে কী এমন রেষারেষি লুকিয়ে ছিল?
পুলিশ রেকর্ড বলছে, নিছকই কয়েক আঁটি সর্ষে চুরি। পুলিশের এক কর্তা মুচকি হেসে ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘অবাক হবেন না, মুর্শিদাবাদ এই রকম ঠুনকো কারণেই রক্তাক্তহয়!’’
সাগরদিঘির বন্যেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সেখদিঘি বাসস্টপ লাগোয়া গ্রাম, হাজিপুর। গ্রামের সালিস-মজলিস এবং এক চিলতে খেতি জমির দখলদারি নিয়ে মোদ্দাসার শেখ আর আব্দুল হাইয়ের রেষারেষিটা বহু দিনের। ১৯৭৯ সালের এক রাতে খেত থেকে কয়েক আঁটি সর্ষে চুরি গিয়েছিল। আব্দুলের ছেলে, সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ সিপিএমের বেলালউদ্দিন শেখ বলছেন, ‘‘কোনও প্রমাণ ছাড়াই এক জনকে চোর অপবাদ দেওয়া যায়? আমার মেজো ভাই কাওসার আলি তারই প্রতিবাদ করেছিল। তার ‘শাস্তি’ কী হল, না মোদ্দাসরের লোক জন তাকে কুপিয়ে খুন করে গেল।’’
কাওসার খুনের কয়েক মাসের মধ্যেই মোদ্দাসার ও তার দাদা মিরাজুদ্দিন শেখকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। জামিন মিললেও তাদের সপ্তাহান্তে থানায় হাজিরা দিতে হত। সেই হাজিরা দিয়েই এক রাতে বাড়ি ফেরার পথে খুন করে জাতীয় সড়কে ‘ফুটবল’ খেলা হয়েছিল।
সিপিএমের বন্যেশ্বর লোকাল কমিটির সদস্য বেলালউদ্দিন বলছেন, ‘‘তা, সেই খুনে সাজা হল গোলাম মুস্তাফার। আমার বড়দা ওয়াসেফ আলির কপালে জুটেছিল তিন বছরের সাজা। সেই ‘লঘু’ সাজা মনোপুঃত হয়নি প্রতিপক্ষের। ১৯৮৪’র এক জুলাই রাতে তাই বেলালউদ্দিনের বাবা আব্দুল হাই আর ভগ্নিপতি জিল্লার রহমানের মুণ্ডু কেটে পাল্টা ফুটবল হয়েছিল গ্রামের রাস্তায়।’’
ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছিলেন সিপিএমের বেলালউদ্দিন। আর, কংগ্রেসের টিকিটে মোদ্দাসার। রাজনৈতিক মেরুকরণের ফলে তাদের বিবাদেও লেগেছিল রাজনীতির রং।
আব্দুল-জিল্লার খুনের পরে প্রায় দশক ঘুরে গেলেও তাদের শত্রুতার আগুন জ্বলছিলই। এ বার এক পক্ষের নেতৃত্ব এলেন বেলালউদ্দিন। অন্যপক্ষের নেতা মোকারবিন। মোকারবিনরা ছয় ভাই— মোকারবিন শেখ, বাবুজান, কলিমুদ্দিন, রাসেদিন, জাহেদিন এবং মুক্তি মহসিন। তাঁদের বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে জাতীয় সড়ক লাগোয়া সেখদিখি বাসস্টপ। দোকান-বাজারের পসারের কারণে ওই তল্লাট গঞ্জের চেহারা নিয়েছিল। সেখদিঘির মোড় আর মোকারবিনের বাড়ির মাঝামাঝি এলাকায় বেলালউদ্দিনের বাড়ি। সেখদিঘি মোড়ে ছিল কলিমুদ্দিনের সারের দোকান, বাবুজানের হার্ডওয়্যারের। রাসেদিনের রেশন দোকান ছিল বাড়িতেই।
১৯৯৬ সালের ২ ডিসেম্বরের সকাল সাড়ে সাতটা। প্রতি দিনের মতো সেখদিঘি মোড়ে গিয়ে একটি দোকানে বসে সবে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়েছিল মোকারবিন। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, নিজের দোকান খোলার জন্য কলিমুদ্দিনও তখন সেখদিঘি মোড়ে পৌঁছে গিয়েছেন। পুরনো একটি বাস কেনার জন্য রামপুরহাট যাওয়ার জন্য বাবুজান দাঁড়িয়েছিল বাসস্টপে। ছয় ভায়ের পঞ্চমজন জাহেদিন বলেন, ‘‘সব্জি কেনার জন্য ছোড়দা রাসেদিন সেখ দিঘি মোড়ের দিকে রওনা দিয়েছিলেন। বেলালাউদ্দিনের বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই তাঁকে বোমা মারা হল। শব্দ শুনে বড়দা মোকারবিন চায়ের দোকান থেকে উঠে দাঁড়াতেই ছুটে এল গুলি। লুটিয়ে পড়লেন তিনি। এর পর তাড়া খেয়ে মেজদা বাবুজানকে মাঠের মধ্য়ে ফেলে কুপিয়ে খুন করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে সেজদা কলিমুদ্দিন তাঁর শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলে।’’ একটু দম নেনে জাহেদিন। তারপর ভেহে ভেঙে বলছেন, ‘‘সেখানেও নিস্তার মেলেনি। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁকে।’’
৪ ভাই খুনে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল বেলালুদ্দিন-সহ সিপিএমের ৫২ জন সমর্থকের বিরুদ্ধে। সেই সময় সেখদিঘি গিয়ে মৃতের পরিবারের লোকজনদের সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি সুবিচারের আশ্বাস দেন তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র আর যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কানাঘুসো ছিল-পালাবদলের পরে চার-ভাই খুনের একটা কিনারা হবে। বাস্তবে কী হল? জাহেদিন বলছেন—‘‘আমার চার ভাইজানকে যারা খুন করেছিল, সেই পাঁচ আসামির চার জনেই ভিড়ল তৃণমূলে। তার পর সব কেমন ধোঁয়াশার ভরে গেল জানেন।’’
সেই ধোঁয়ার আড়ালে কুয়াশা মাখা জাতীয় সড়কে পুরনো মানুষেরা এখনও যেন দেখে ফেলেন, ‘আদিম ফুটবল’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy