গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
সিস্টার নিবেদিতাকেও শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল। রাজনীতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ায় সঙ্ঘে তাঁর প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন। পরে ভরত মহারাজের মতো প্রবীণ সন্ন্যাসীকেও ‘রাজনৈতিক সংস্রবের’ কারণেই পড়তে হয়েছিল সতর্কবার্তার মুখে। রামকৃষ্ণ মিশনের সেই লৌহকঠিন শৃঙ্খলা কি কিছুটা আলগা হয়ে এসেছে? সেই ফাঁকফোকর গলেই কি রাজনীতির জল ঢুকছে মিশনের আঙিনায়? বেশ কিছু দিন ধরেই কেউ কেউ প্রশ্নটা তুলছিলেন মৃদু স্বরে। বেলুড় মঠে নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের পরে আর একটু স্পষ্ট ভাবে উঠতে শুরু করেছে প্রশ্নটা।
সঙ্ঘ সব সময় রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে— স্বামী বিবেকানন্দের বার্তা তেমনই ছিল। তাঁর জীবদ্দশায় রাজনীতির ছোঁয়াচ পুরোপুরি এড়িয়ে চলেছে রামকৃষ্ণ মিশন। পরে বঙ্গভঙ্গ রোখার জন্য স্বদেশি আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সিস্টার নিবেদিতা আর রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেননি। আন্দোলনে শামিল হয়ে যান।
ভাবাদর্শ এবং শৃঙ্খলা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য, সে সময়ে তার প্রমাণ মিলেছিল। স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা হওয়া সত্ত্বেও নিবেদিতাকে সঙ্ঘের কাজকর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
রামকৃষ্ণ মিশনে ইন্দিরা গাঁধী-ফাইল চিত্র।
অনেক পরে ভরত মহারাজের মতো প্রবীণ সন্ন্যাসীকেও সতর্কবার্তার মুখে পড়তে হয়। ভরত মহারাজের ভক্ত হিসেবে সুবিদিত ছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। তাঁর জন্য ভরত মহরাজের দরজাও অবারিত ছিল। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষ অলিন্দের সঙ্গে কোনও সন্ন্যাসীর যোগাযোগকে সঙ্ঘ ভাল ভাবে নেয়নি। অতএব ভরত মহারাজকেও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়, অন্তত এক বারের জন্য হলেও।
আরও পড়ুন: এনপিআর ফর্ম নিয়ে ভুল বোঝাচ্ছে কেন্দ্রঃ মমতা
ভাবাদর্শের প্রতি সেই নিষ্ঠা এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেই শৃঙ্খলা পরায়ণতা কি ক্রমশ শিথিল হল কিছুটা?
তা কিন্তু নয়। পরেও বহু বছর রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব বহাল রাখার নীতিতে রামকৃষ্ণ মিশন অটল থেকেছে। তার জন্য মিশনকে সমস্যার মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
স্বামী আত্মস্থানন্দের সাক্ষাৎপ্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-ফাইল চিত্র।
উত্তর কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের জন্মভিটে এবং সংলগ্ন অংশের সংস্কারের কথা অনেক দিন ধরেই ভাবছিল রামকৃষ্ণ মিশন। কিন্তু নানা আইনি জটিলতা তো ছিলই, ছিল স্থানীয় স্তরে কিছু অসহযোগিতাও। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা প্রশাসনিক সমর্থন চেয়ে সে সব সমস্যার সমাধান সহজেই করিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে কোনও রকম যোগসূত্র না রাখা সন্ন্যাসীরা তখন জানতেনই না, কাকে বলতে হবে, কার কাছ থেকে সহায়তা চাইতে হবে। অবশেষে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রভাবশালী শুভানুধ্যায়ীদের হস্তক্ষেপে বিষয়টা পৌঁছয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে। তিনি উদ্যোগী হয়ে স্বামীজির জন্মভিটে এবং সংলগ্ন অংশ-সহ মোট ৬৪ কাঠা জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন। তার পরে সংস্কারের কাজ শুরু হয়।
শিকাগো ধর্মসভায় স্বামীজির ভাষণের ১২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-ফাইল চিত্র।
এর পরেও কিন্তু দীর্ঘ দিন ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরেই থেকেছে মিশন। রাজনীতির শীর্ষ মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো করে বেড়েছে মূলত গত ৬-৭ বছরে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার যে ভাবে রামকৃষ্ণ মিশনে ছুটে গিয়েছেন, নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, বাম জমানার মুখ্যমন্ত্রীরা তেমন করেননি। মমতাও যে শুরু থেকেই এতটা ঘনিষ্ঠতার ছবি তুলে ধরতে আগ্রহী ছিলেন, তা নয়। বিজেপির মোকাবিলা এ রাজ্যেও গুরুত্ব দিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা যখন থেকে অনুভব করেছে তৃণমূল, তখন থেকেই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতা বেশি করে দৃশ্যমান হয়েছে।
আরও পড়ুন: সিএএ বিরোধী প্রস্তাব আসছে এ রাজ্যেও
ঠিক একই কারণে স্বামীজির জন্মভিটে সংস্কারের সময়ে জ্যোতি বসু অগাধ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন, বলছে ওয়াকিবহাল মহল। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল্লির সরকার নাম কিনে নিক, তা জ্যোতি বসুরাও চাননি সে সময়ে।
স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী-ফাইল চিত্র।
কিন্তু এখন তা হলে পরিস্থিতিটা কী রকম দাঁড়াল? এক দিকে মোদী বার বার রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের কথা তুলে ধরতে থাকলেন। সন্ন্যাস নিতে চেয়ে কবে স্বামী আত্মস্থানন্দের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, সে বৃত্তান্ত বার বার শোনাতে লাগলেন। সুযোগ পেলেই রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে-মন্দিরে শ্রদ্ধা জানাতে যেতে থাকলেন। অন্য দিকে, মমতাও উপুড়হস্ত হলেন মিশনের জন্য। নানা ভাবে বার্তা দিতে থাকলেন যে, তিনি মিশনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
রামকৃষ্ণ মিশনও কি সেই স্রোতেই গা ভাসাতে শুরু করে দিল? নিন্দুকদের বক্তব্য, ক্ষমতার সর্বোচ্চ অলিন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে যে বিপুল আর্থিক আনুকূল্য মেলে, মিশন এখন তার স্বাদ পেতে শুরু করেছে। তাই কঠোর ভাবে রাজনীতির সংস্রব এড়িয়ে যাওয়ার নীতি কিছুটা শিথিল হয়েছে।
গত ১২ জানুয়ারি বেলুড় মঠে নরেন্দ্র মোদী-ফাইল চিত্র।
সঙ্ঘের পরিচালন পদ্ধতি যাঁরা বিশদে জানেন, তাঁরা অবশ্য বলছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের শৃঙ্খলা শিথিল হয়ে পড়া অতটা সহজও নয়। যে ভাবাদর্শ এবং যে সংযমের শিক্ষা ব্রহ্মচর্য থেকেই দেওয়া শুরু হয় সঙ্ঘে, তা এত অল্পে বা এত কম সময়ের মধ্যে গুলিয়ে যাওয়ার নয়। তাই সঙ্ঘের অন্দর মহলেই সতর্কবার্তার আদান-প্রদান শুরু হয়েছে বলে খবর। রাজ্যের শাসকদের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার ফলও ইতিমধ্যে পেতে হয়েছে এক সন্ন্যাসীকে। বেলুড় মঠ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যত্র। অতএব মিশন ঘনিষ্ঠরা বলছেন, অন্য কোনও শীর্ষ রাজনীতিকের প্রতি কোনও সন্ন্যাসী অতিরিক্ত বাৎসল্য দেখাচ্ছেন বলে যদি সঙ্ঘের মনে হয়, তা হলে তাঁর কার্যকলাপও অবাধ থাকবে না। নিজের অতীত থেকে যদি শিক্ষা নেয় রামকৃষ্ণ মিশন, তা হলে তেমনই হওয়ার কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy