রোগীর শরীর থেকে নেওয়া দেহরস ও কোষের নমুনা-সহ এই সিরিঞ্জই রোগীর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফাইল চিত্র।
রাজ্যের অন্যতম সেরা মেডিক্যাল কলেজ আরজি কর সম্ভাব্য ক্যানসার রোগীর ক্ষতস্থান থেকে ‘এফএনএসি’ পদ্ধতিতে সংগৃহীত দেহরস ও কোষের নমুনা সিরিঞ্জ-সহ রোগীর হাতেই ধরিয়ে দিল! এবং সেই নমুনা নিয়ে গিয়ে বাড়ির সাধারণ ফ্রিজে ডাল, ভাত, তরকারির পাশেই রেখে দিতে বলা হল সারা রাত।
কেন?
হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগে ৫টার পরে তালাচাবি পড়ে যায় যে! তাই নাকি সেখানে নমুনা রাখা যাবে না। গত ৮ নভেম্বর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এই অকল্পনীয় ঘটনা নিয়ে অভিযোগ পেয়ে স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারাও স্তম্ভিত!
কারও ক্যানসার হয়েছে কি না, তা নির্ধারণের জন্য এফএনএসি পরীক্ষার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরের যে-অংশে ওই রোগ ছড়িয়েছে বলে আশঙ্কা, এই পদ্ধতিতে সিরিঞ্জের মাধ্যমে সেখান থেকে দেহরস ও কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। রেডিয়োলজির চিকিৎসকেরা জানান, ঠিকঠাক ফলের জন্য নমুনা সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার জন্য জমা দিতে হয় অথবা যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করে যথাশীঘ্র পরীক্ষা করতে হয়। নইলে ঠিক রিপোর্ট মেলে না।
অথচ ক্যানসারের স্বতন্ত্র বিভাগ থাকা সত্ত্বেও আরজি করের মতো প্রথম সারির মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়েলজি বিভাগে ৫টার পরে আর এফএনএসি-র নমুনা জমা নেওয়া হয় না। প্যাথলজি বিভাগও বেলা ১টার পরে এফএনএসি করে না। তা হলে বেলার দিকে বহির্বিভাগ বা অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা যে-সব রোগী এফএনএসি-র জন্য আসেন, তাঁদের পরিণতি কী হয়?
ওই হাসপাতালে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য পিপিপি মডেলে চুক্তিবদ্ধ ‘মেদিনীপুর ডায়াগনস্টিক্স প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা জানিয়েছে, সে-ক্ষেত্রে রোগীর হাতে নমুনা ধরিয়ে বাড়ির ফ্রিজে রেখে দিতে বলা ছাড়া গতি নেই। যার সাক্ষী বালির বাসিন্দা বছর বাহান্নর স্বপন গুহ এবং তাঁর পরিবার। স্বপনবাবুর বাঁ দিকের ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত বলে সন্দেহ করে হাওড়ার চাঁদমারি ইএসআই হাসপাতাল থেকে তাঁকে আরজি করে পাঠানো হয়। ৫ নভেম্বর
আরজি করে বক্ষ বিভাগের বহির্বিভাগে দেখানোর পরে সেখান থেকে বলা হয়, এফএনএসি করাতে হবে। সেই পরীক্ষার জন্য স্বপনবাবুরা ৮ নভেম্বর বেলা ১১টায় ওই হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও ৫টা পর্যন্ত তাঁদের বসিয়ে রাখা হয় বলে অভিযোগ। ৫টার পরে এক জন ডাক্তার এসে বিনা অ্যানেস্থেশিয়ায় অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক সেই নমুনা সংগ্রহ করেন। সেই নমুনা-সহ সিরিঞ্জ রোগীর হাতে দিয়ে বলা হয়, বাড়ির ফ্রিজে সেটি রাখতে হবে এবং পরের দিন ফের নিয়ে এসে জমা দিতে হবে।
স্বপনবাবুর আত্মীয়া আত্রেয়ী বসু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা স্তম্ভিত, বিস্মিত। কোনও সভ্য জায়গায় এমন ঘটনা ঘটতে পারে, বিশ্বাস হয় না! ক্যানসার হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াটা যে-পরীক্ষার উপরে নির্ভর করছে, তাকে নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে। রোগীরা সব খেলার বস্তু!’’
স্বপনবাবুর স্ত্রী রঞ্জিতা গুহ জানান, সিরিঞ্জভর্তি দেহরস হাতে ধরে তাঁরা কী ভাবে বালি পর্যন্ত যাবেন, জানতে চাইলে হাসপাতালের কর্মীরা সটান বলে দেন, ‘‘সেটা আপনারা বুঝে নিন।’’ সিরিঞ্জ নিয়ে যেতে কোনও বাক্স বা প্লাস্টিকও দেওয়া হয়নি। সিরিঞ্জ হাতে ধরে ট্যাক্সিতে তাঁরা বাড়ি যান। সাধারণ ফ্রিজে আনাজ, মিষ্টি, খাবারের পাশেই তা রাখতে বাধ্য হন। পরের দিন একটা বাক্সে বরফ দিয়ে সেই সিরিঞ্জ আবার হাসপাতালে এনে কলেজ বিল্ডিংয়ে মাইক্রোবায়োলজির ২০৪ নম্বর ঘরে জমা দেন।
প্যাথলজি বিভাগ ১টার পরে আর এফএনএসি করে না কেন? কেনই বা ৫টার পরে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ এফএনএসি-র নমুনা জমা নেয় না? জবাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধানেরা একযোগে বলেছেন, ‘‘কলেজ-কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করুন।’’ কলেজের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ফোন ধরেননি, টেক্সটের জবাবও দেননি।
পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য পিপিপি মডেলে হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সংস্থার কাছেও জানতে চাওয়া হয়, কেন তারা সিরিঞ্জ-সহ নমুনা রোগীকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ফ্রিজে রাখতে বলল? সংস্থার ম্যানেজার রাজেশ সাউয়ের জবাব, ‘‘রোগীকে যাতে আরও এক বার পরীক্ষার জন্য আসতে না-হয়, সেটা মাথায় রেখে তাঁর হেনস্থা কমাতেই এটা করেছি। কল দিলেও ডাক্তারেরা পরীক্ষা করতে আসতে দেরি করেন। তত ক্ষণে অনেক দিনই মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের নমুনা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাই রোগীকে নিয়ে যেতে বলি।’’
কিন্তু ভুল পদ্ধতিতে, ভুল তাপমাত্রায় খাবারদাবারের সঙ্গে ফ্রিজে রেখে দেওয়ায় বা রাস্তার ধুলোবালি লেগে সেই নমুনা কতটা নষ্ট হচ্ছে, তার খোঁজ কি তাঁরা রাখেন? সংরক্ষণের পরিকাঠামো না-থাকলে কেন তাঁরা ৫টার পরে নমুনা সংগ্রহ করবেন? সেটা কি শুধু টাকার জন্য?
এ বার রাজেশবাবু নিরুত্তর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy