গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
নাম-বিভ্রাটের জেরে দীর্ঘদিন আগে স্কুল ছেড়ে যাওয়া এক প্রাক্তন ছাত্রীর অ্যাকাউন্টে ঢুকে গিয়েছে বর্তমান ছাত্রীর ট্যাবের টাকা। বীরভূমের কীর্ণাহারে। কিংবা শিলিগুড়ি শিক্ষা-জেলায় লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছিল ট্যাবের টাকা। হ্যাকার বা দুষ্টচক্রের কার্যকলাপ যেমন রাজ্য জুড়ে ট্যাব কেলেঙ্কারির একটি দিক, আর একটি দিক স্কুলের তরফে তথ্য-ভ্রান্তির। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ এই পরিস্থিতির জন্য স্কুলগুলিতে ‘গ্রুপ সি’ বা ‘গ্রুপ ডি’ পদ শূন্য পড়ে থাকার দিকে আঙুল তুলছেন। যে সরকারি পোর্টালের মাধ্যমে ট্যাবের জন্য পড়ুয়াদের নথিভুক্তি করা হয়, তার ‘খামখেয়ালের’ দিকেও আঙুল তুলছেন অনেকে।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু স্কুলগুলিতে ‘গ্রুপ সি’ বা ‘গ্রুপ ডি’ পদ ফাঁকা থাকা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেননি। তবে দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, ‘গ্রুপ সি’ পদে ২০১৬-র পরে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ না হয়নি ঠিকই, তবে কেউ চাকরিরত অবস্থায় মারা গেলে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা অথবা বৈধ উত্তরাধিকারী হিসাবে গত তিন বছরে ‘গ্রুপ সি’ বা ‘গ্রুপ ডি’ পদে শ’পাঁচেক নিয়োগ হয়েছে। যদিও ফের কবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ হবে, সে বিষয়ে তিনি কিছুজানাতে পারেননি।
শিক্ষা দফতর সূত্রের দাবি, শিক্ষক-শিক্ষিকারা যখন ‘বাংলার শিক্ষা’ পোর্টালে পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্ট নম্বর আপলোড করেন, আপলোড-পর্ব মেটার পরে সে তথ্য তাঁদের ডাউনলোড করে ‘প্রিন্ট আউট’ নিয়ে মিলিয়ে দেখার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হচ্ছে না। কোচবিহারের একটি স্কুলে তেমনই হয়েছে। কেন? শিক্ষা দফতরের দাবি, মনোযোগের অভাব। তবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দাবি, বহু স্কুলে অশিক্ষক কর্মীর অভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপরে তৈরি হওয়া কাজের চাপ, একটা বড় কারণ।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের খেয়াদহ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলতাফ শেখ বলেন, “স্কুলে ক্লার্ক নেই। ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নেই। স্কুলগুলিতে ‘তরুণের স্বপ্ন’-এর মতো ১৭টি প্রকল্প চলে। সারা বছর এই সব প্রকল্পের জন্য পোর্টালে তথ্য আপলোড করার কাজ করতে হয়। ফলে, বাধ্য হয়ে স্কুলকে যেতে হচ্ছে সাইবার ক্যাফেতে। এই পরিকাঠামো থাকলে, হ্যাকারেরা সহজেই হ্যাক করতে পারবে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালে খড়ার শ্রী অরবিন্দ বিদ্যামন্দিরের ৪২ জন পড়ুয়ার টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। এই স্কুলে কোনও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নেই। স্কুলের আইসিটি (ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি)-র শিক্ষক সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে পড়ুয়াদের নাম ও অ্যাকাউন্ট নম্বর নথিভুক্তি করা-সহ স্কুলের ডেটা এন্ট্রি সংক্রান্ত কাজ করেন। তাঁকে সাহায্য করেন স্কুলের অন্য শিক্ষকেরা। পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া গর্ভমেন্ট স্পনসর্ড বিবেকানন্দ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরিদাস ঘটক বলেন, “আমাদের স্কুলে তিন জন করণিকের (ক্লার্ক) পদ রয়েছে। একটিতেও লোক নেই। গ্রুপ ডি পদে পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন নেই। ‘তরুণের স্বপ্ন’র নাম নথিভুক্ত করার এই বিপুল কাজ কাকে দিয়ে করাব?’’
রাজ্যের একাধিক প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকার দাবি, এ বার একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াকে এক সঙ্গে ট্যাবের টাকা দেওয়া হচ্ছে। রাজ্য জুড়ে সে সংখ্যাটা প্রায় ১৬ লক্ষ। কম সময়ে প্রচুর পড়ুয়ার অ্যাকাউন্ট নম্বর আপলোড করতে হচ্ছে স্কুলের তরফে। সেখানে ভুল হতে পারে।
উত্তর দিনাজপুরে ১৬৯টি হাইস্কুলের মধ্যে ৭০টিরও বেশি স্কুলে স্থায়ী করণিক নেই। এবিটিএর জেলা সম্পাদক বিপুল মৈত্র বলেন, ‘‘স্থায়ী করণিকের অভাব ও অভিজ্ঞতার কারণে স্কুলের পোর্টালের তথ্য বাইরে গিয়ে বিকৃতি ঘটছে, এ কথা সত্য। কিন্তু ওই পোর্টাল বিভিন্ন সরকারি দফতরেও খোলার ব্যবস্থা আছে। ফলে, সেখান থেকে কোনও কারণে জালিয়াতি হচ্ছে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’’
স্কুল স্তর থেকে পড়ুয়াদের নাম, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আপলোড হয়ে যাওয়ার পরে তা শিক্ষা দফতরের একাধিক স্তরে যাচাই হয়। তার পরে টাকা মঞ্জুর হওয়ার প্রশ্ন। ‘অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেসেস’-এর রাজ্য সম্পাদক চন্দন মাইতি বলেন, “প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পে সরকার দিচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকার গোলমাল কোন স্তর থেকে হচ্ছে, তা সর্ব স্তরে তদন্ত হোক।’’ ‘পশ্চিমবঙ্গ স্কুল ও মাদ্রাসা ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশন’-এর মালদহ জেলা সম্পাদক কালীশঙ্কর দাস বলেন,“শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী প্রকল্প নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না। ট্যাবের ক্ষেত্রে সব খতিয়ে দেখা হয়নি বলে মনে হচ্ছে।”
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ আঙুল তুলছেন ‘বাংলার শিক্ষা’ প্রকল্পের সমস্যাও নিয়ে। তাঁদের দাবি, ওই পোর্টালের ‘লিঙ্ক’ অনেক সময় থাকে না। ‘লিঙ্ক’ এলেও স্থায়ী হয় না। সোনারপুরের প্রসাদপুর ভাগ্যধর বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক দেবাশিস মণ্ডল বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতর নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সবার তথ্য আপলোড করতে হবে বলে দিচ্ছে। কিন্তু পোর্টালের খামখেয়ালের কারণে তথ্য আপলোড করতে গিয়ে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছেন অনেকে। তাতে ভুল হতে পারে। আর সাইবার জালিয়াতেরা সে ভুলের সুযোগ নিতে পারে।’’ তাঁর মতে, ‘‘বাংলার শিক্ষা পোর্টালের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। না হলে এই তরুণের স্বপ্ন প্রকল্প শিক্ষকদের কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘পোর্টালের প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত দিক দেখা হবে। এটা যান্ত্রিক বা প্রযুক্তিগত বিষয়। কিছু পরিবর্তন হলে তা পোর্টালেই জানিয়ে দেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy