বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক ফের চালু করার জন্য সমবায় দফতর ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করার সুপারিশ করে ফাইল পাঠিয়েছে অর্থ দফতরকে। কিন্তু ছয় সপ্তাহ পেরিয়েও অর্থ দফতর থেকে মেলেনি ছাড়পত্র। ফলে সাত মাসেও ব্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটল না। প্রায় দু’লক্ষ ৬৫ হাজার আমানতকারীর প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত।
সরকারি দফতর ও তৃণমূলের অভ্যন্তরের সূত্রের খবর, ব্যাঙ্ক খোলার জন্য বিপুল আর্থিক বরাদ্দ করলেও তারপর ব্যাঙ্ক ফের চালু হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ব্যাঙ্ক খুললেই যদি আমানতকারীরা তাঁদের গচ্ছিত টাকা তুলে নিতে শুরু করেন, তা হলে ব্যাঙ্ককে ফের ঝাঁপ বন্ধ করতে হবে। কার্যত জলে যাবে রাজ্য সরকারের ৭০ কোটি টাকা। অন্য দিকে, বীরভূমে এখন বিরোধীদের যে ভাবে উত্থান হচ্ছে, তাতে ব্যাঙ্ক খোলার রাজনৈতিক ফায়দা আদৌ তৃণমূলের কাছে আসবে কিনা, সে বিষয়েও সন্দিহান দলের একাংশ।
বীরভূমের তৃণমূল নেতারা অবশ্য বারবার দলের নেতৃত্বের কাছে দরবার করছেন ব্যাঙ্ক খোলার জন্য। গত মাসের গোড়ায় জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সংবাদিকদের জানিয়ে দেন, শীঘ্রই ব্যাঙ্ক খোলা হবে, কারণ রাজ্য সরকার টাকা বরাদ্দ করেছে। জেলা তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য, জেলার ৩৬ লক্ষ বাসিন্দার মধ্যে ১২ লক্ষ কোনও না কোনও ভাবে ব্যাঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। দলীয় সূত্রে খবর, ব্যাঙ্ক খুলতে যত দেরি হচ্ছে জেলা তৃণমূল নেতৃত্বকে সাধরণ গ্রাহকদের প্রশ্নে ততই জেরবার হতে হচ্ছে। বিরোধী দলগুলিও সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে জেলায় নিজেদের সংগঠন মজবুত করছে।
তাই দ্রুত ব্যাঙ্ক খোলার দাবি নিয়ে তদ্বির করতে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান, অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ নুরুল ইসলাম, সকলেই কলকাতায় বারবার এসেছেন। সমবায় দফতর, অর্থ দফতরের কর্তাদের কাছে দরবার করেছেন। সেই দাবি মেনেই সমবায় মন্ত্রিগোষ্ঠী ব্যাঙ্ক খোলার জন্য অর্থ বরাদ্দে রাজি হয়েছে। রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী জ্যোতির্ময় কর বলেন, “আমরা ব্যাঙ্কের পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছি। কিছু বিধিনিয়মের সমস্যা রয়েছে। তার সমাধান করে শীঘ্রই ব্যাঙ্ক খোলা হবে।” তবে তা কবে, তা নির্দিষ্ট করে মন্ত্রী বলতে পারেননি। ব্যাঙ্কের এই সঙ্কটের জন্য তিনি বামফ্রন্ট সরকারের দুর্নীতিকেই ফের দায়ী করেন।
অর্থ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, ব্যাঙ্কের জন্য ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করায় কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যাঙ্কের লেনদেন চালু হলে ৩৫০ কোটি টাকা আমানতকারীরা তুলে নিতে পারেন। তাতে ব্যাঙ্কের আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা মুশকিল হবে। রাজ্য তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, “বীরভূমে দিনের পর দিন আমাদের সংগঠন কিছুটা হলেও দুর্বল হয়েছে। ব্যাঙ্ক খোলা হলে রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে যাবে না। তাই ব্যাঙ্ক খোলার আগে রাজ্য সরকার কয়েকটি দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবে।” সে সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি, তা কার্যত স্বীকার করে অর্থ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “উচ্চতম স্তর থেকে সবুজ সংকেত না পেলে এই ফাইল ছাড়া যাবে না। তা এখনও মেলেনি।”
প্রায় ৬২ কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী হয়ে যাওয়ায় ২০০৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বীরভূমের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সব শাখায় ঋণদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাঁচ বছর পরেও পরিস্থিতি না বদলানোয় কোনও নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না জানিয়ে দেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। গত ১৫ মে ব্যাঙ্কের লাইসেন্স বাতিল হয়। এরপর প্রায় সাত মাস ধরে ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখার আমানতকারীরা উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। সুদ তো দূরের কথা আসল পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন তাঁরা। ব্যাঙ্কের অধীনে থাকা ৩৩১টি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রায় ১২ লক্ষ চাষি, তন্তুবায়, শিক্ষক ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা। সবচেয়ে বেশি সমস্যা পড়েছেন তাঁরাই। চাষের কাজের জন্য বীজ থেকে সার, কোনও কিছুই পাচ্ছেন না। এমনকী জমানো টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, মিড ডে মিল, বার্ধক্য-বিধবা-অক্ষম ভাতা, রাষ্ট্র্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার মতো সরকারি প্রকল্পের টাকাও তুলতে পারছেন না।
ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকার পর থেকে জেলায় বিরোধী দলের তরফে এবং আমানতকারীরা বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। খোলার দাবিতে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। যে কারণে শাসক দলের অস্বস্তি বেড়েছে। সমবায় বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠী ব্যাঙ্ক খোলার বিষয়ে নীতিগত ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থ দফতরের কাছে টাকা বরাদ্দ করার বিষয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে। কিন্তু শেষরক্ষা হবে কী না, হলে কবে হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy