সিট-এর (বিশেষ তদন্তকারী দল) তদন্তে অসন্তুষ্ট হয়ে সিবিআই চেয়ে তাঁরা আগেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এ বার নিম্ন আদালতে মামলার সরকারি আইনজীবীর বিরুদ্ধেই নিজেদের অনাস্থার কথা জানালেন পাড়ুইয়ের নিহত সাগর ঘোষের পরিবার। সোমবার রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে মামলার সরকারি আইনজীবী বদলের আর্জি জানালেন নিহতের স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ। এ দিন তাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ জেলাশাসকের দফতরে ওই চিঠি জমা দিয়েছেন।
চিঠি জমা দিয়ে এ দিন হৃদয়বাবু দাবি করেন, “মামলার সরকারি আইনজীবী রণজিত্ গঙ্গোপাধ্যায় রাজনৈতিক মদতপুষ্ট। তিনি অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছেন। আমাদের সঙ্গে কোনও রকম সহযোগিতাও করছেন না।” তাঁর আরও বক্তব্য, “মামলার সরকারি আইনজীবীই যদি তিনি এ ভাবে পক্ষপাত মূলক আচরণ করে যান, তা হলে আমরা নিরপেক্ষ বিচার পাব কী করে!” তাই রণজিত্বাবুর বদলে অবিলম্বে অন্য কাউকে মামলার সরকারি আইনজীবী করার দাবি তাঁরা জেলাশাসককে জানিয়েছেন।
এ দিকে, অভিযুক্ত আইনজীবী অবশ্য সাগরবাবুর পরিবারের সমস্ত অভিযোগই ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “একটি অরাজনৈতিক চেয়ারে বসে যে নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করা উচিত, সেটাই করেছি। আমার বিরুদ্ধে এ নিয়ে কোনও তথ্য প্রমাণ যদি ওঁরা পেশ করতে পারেন, তা হলে মাথা নীচু করে সরে যাব। আমি নিরপেক্ষ ভাবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি, কি করিনি, বিচারকের নির্দেশ ও মামলার সংশ্লিষ্ট নথিপত্রই তা বলবে।”
আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, সরকারি আইনজীবীর ‘অ্যাপোয়েন্টিং অথরিটি’ জেলাশাসকই। কেউ এই ধরনের আবেদন জানালে নিয়ম হল, জেলাশাসক প্রথমে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। অভিযোগের কোনও সত্যতা পেলে সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মামলা থেকে ওই সরকারি আইনজীবীকে সরিয়ে অন্য পিপি বা এপিপিকে জেলাশাসক দায়িত্ব দিতে পারেন। অথবা তিনি হাইকোর্টের লিগাল রিমাম্বারেন্সের কাছে এ ব্যাপারে নোটও পাঠাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জেলাশাসক ঠিক কী পদক্ষেপ করেন, তা সময়ই বলবে। তবে, সোমবার বিকেল পর্যন্ত তাঁর হাতে এমন কোনও আবেদন এসে পৌঁছয়নি বলে দাবি করেছেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী।
প্রসঙ্গত, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে খুন হন পাড়ুইয়ের বাঁধ নবগ্রামের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর ঘোষ। ওই খুনের ঘটনায় নাম জড়িয়ে যায় জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং তাঁর অনুগামীদের। তবে, ওই হত্যা মামলার তদন্তের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত সিট গত ১৬ জুলাই সিউড়ি জেলা আদালতে যে চার্জশিট জমা দেয়, তাতে মূল অভিযুক্ত অনুব্রতর নাম ছিল না। সিট-এর তালিকায় রয়েছে তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফা-সহ আট নিচুতলার তৃণমূল কর্মীর। ইতিমধ্যে অভিযুক্তদের মধ্যে মুস্তফার ছেলে শেখ আসগর ছাড়া সাত জনই গ্রেফতার হয়েছেন। ভগীরথ ঘোষ এবং সুব্রত রায় ছাড়া বাকিরা জামিনে মুক্ত রয়েছেন।
ওই চার্জশিটের ভিত্তিতে গত ৮ জানুয়ারি সিউড়ি আদালতে মামলার চার্জ গঠিত হয়েছে। পরের দিন থেকেই সিউড়ির জেলা জজ গৌতম সেনগুপ্তের এজলাসে ওই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, ঘটনা হল, আদালতের পাঠানো সমন গ্রহণ করেও নির্ধারিত প্রথম তিন দিন ৯ জন সাক্ষীর (নিহতের স্ত্রী সরস্বতীদেবী, ছেলে হৃদয় ঘোষ এবং পুত্রবধূ শিবানী ঘোষ ছাড়াও পরিবারের কয়েক আত্মীয়) কেউ-ই উপস্থিত হননি। তার জেরে সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে যায়। ক্ষুব্ধ আদালত সরস্বতীদেবী এবং পঞ্চানন ঘোষ ছাড়া সকলের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে। একমাত্র ওই দু’জনই নিজেদের শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন। চতুর্থ ও পঞ্চম দিন অবশ্য মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ওই দু’দিন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এবং বোলপুর হাসপাতালের দুই চিকিত্সক মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ঘটনা হল, প্রথম থেকেই সিট-এর তদন্তের ভিত্তিতে চার্জ গঠিত হওয়া এই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর বিপক্ষে ছিলেন নিহতের পরিবার। সরস্বতীদেবীর দাবি, “ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। তদন্তে মূল অপরাধীদের অনেককেই আড়াল করা হয়েছে। আমরা চাই সিবিআই ঘটনার তদন্ত করুক। একমাত্র তা হলেই প্রকৃত খুনিরা শাস্তি পাবে।” তাই প্রথম দিনই ওই বিচার প্রক্রিয়াই স্থগিত করার জন্য জেলা জজের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন সরস্বতীদেবী। কিন্তু, এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের কোনও স্থগিতাদেশ দেখাতে না পারায় বিচারক সেই আবেদন মঞ্জুর করেননি। তার পরে হৃদয়দেরও নির্ধারিত দিনে সাক্ষ্য দিতে আসতে দেখা যায়নি। এ বার সরাসরি মামলার সরকারি আইনজীবীর বিরুদ্ধেই পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে জেলাশাসকের কাছে দ্বারস্থ হল ওই পরিবার। যে দেখে রণজিত্বাবু এ দিন পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেছেন, “আসলে ওঁরা তো বিচার প্রক্রিয়া শুরুই করতে দিতে চাইছেন না। তা না হলে সমন নিয়েও কেউ আদালতে সাক্ষ্য না দেয়! শুধু তাই নয়, কেন তাঁরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন না, সেটাও তাঁরা আদলতকে জানাচ্ছেন না। সে কারণে আইনগত যা ব্যবস্থা নেওয়ার আদালত নিয়েছে।” হৃদয়বাবুরা অবশ্য সে অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেই দাবি করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy