কুসংস্কারের বশে মায়ের ‘মাথার ব্যামো’ সারাতে ওঝা ডেকেছিলেন সঞ্জয় বিশ্বাস। ‘ভূত তাড়ানোর’ নামে ওই যুবকের মাকে ঝাঁটা ও বাঁশপেটা করা মেরে ফেলার অভিযোগ উঠল সেই ওঝাদের বিরুদ্ধেই।
শনিবার রাতে বাঁকুড়ার জয়পুর থানার গেলিয়া গ্রামের এই ঘটনা ফের চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল, নানা প্রচার এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচির পিছনে বছরভর প্রচুর টাকা খরচ করেও গ্রামের গরিব মানুষের মন থেকে কুসংস্কার পুরোপুরি তাড়ানো যায়নি। বিশেষ করে গেলিয়ার মতো বর্ধিষ্ণু গ্রামে এমন ঘটনা ঘটায় তা উদ্বেগে রেখেছে প্রশাসনকেও। মৃতার নাম শিবানী বিশ্বাস (৫৮)। রবিবার বিষ্ণুপুরজেলা হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পরে শিবানীদেবীর দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃতার মুখে, পিঠে ও পেটে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছে। সারা শরীরে পেটানোর চিহ্ন স্পষ্ট।
এ দিন হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে মৃতার ছেলে সঞ্জয় দাবি করেন, বহু বছর ধরেই তাঁর মা কিছুটা মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন। একা একা গান গাইতেন। মাঝেমধ্যেই অকারণে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে চুপচাপ বসে থাকতেন। এত দিন ডাক্তার দেখাননি কেন এ প্রশ্নের জবাবে সঞ্জয়ের দাবি, তাঁদের পরিবার অত্যন্ত গরিব। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য হয়নি। যদিও ঘটনা হল, শিবানীদেবীকে কখনওসরকারি হাসপাতাল বা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েও পরীক্ষা করানো হয়নি। পেশায় কাঠমিস্ত্রি সঞ্জয় বলেন, “লোকমুখে শুনেছিলাম, ওঝা-গুণিনরা মাকে ভাল করতে পারবে। তাই ওঝা ডাকি।” স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কোতুলপুরের লাউগ্রামের ওঝা রাখহরি পরামানিক শিবানীদেবীকে পরীক্ষা করে নিদান দেয়, তাঁকে নাকি ভূতে ধরেছে। ভূত তাড়ানোর জন্য যজ্ঞ-সহ নানা আয়োজন করতে হবে। সঞ্জয় বলেন, “ওঝাদের কথা মতো শনিবার রাতে সব আয়োজন করে রাখি। রাখহরি পরামানিকের নেতৃত্বে ৭-৮ জনের একটি ওঝার দল এসেছিল। ঝাড়খণ্ডের লোকও ছিল। ধূপ-ধুনো, পুজা-আচ্চা চলছিল তান্ত্রিক মতে। ভূত তাড়ানোর নামে ঝাঁটা ও বাঁশ দিয়ে নাগাড়ে মারছিল মাকে।”
মার খেতে খেতে নেতিয়ে পড়ছিলেন ওই মহিলা। তবু মার থামছিল না। সঞ্জয়ের দাবি, “ওঝাদের কতবার বললাম, মাকে আর মারবেন না। মরে যাবে! ওরা বলল, ‘চুপ করে দেখে যা। তোর মাকে মারছি না। মার খাচ্ছে তোর মায়ের শরীরে থাকা ভূত’!” একটা সময় নিথর হয়ে পড়ে শিবানীদেবীর শরীর। তখন ওঝার দলকে আটকে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশেরই গাড়িতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান ওই মহিলা। এ দিন হাসপাতাল চত্বরে সঞ্জয় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ভেবেছিলাম সেরে উঠবে, কিন্তু এ কী হয়ে গেল।” গ্রামের বাড়িতে সঞ্জয়ের কষ্টের সংসার। স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ের সঙ্গে থাকতেন বাবা-মা। প্রতিবেশীদের একাংশ জানান, সঞ্জয়ের বাবা বিভূতি বিশ্বাস গান শেখান। তেমন আয় নেই। শিবানীদেবীর অসুস্থতা সারাতে ওঝা ডাকা হয়েছে, এই খবর তাঁদের কাছে ছিল না বলেও তাঁদের দাবি।
এমনিতে গেলিয়া বেশ বড় গ্রাম। হাজার দুয়েক মানুষের বাস। পঞ্চায়েত অফিস এই গ্রামেই। গ্রামে আছে হাইস্কুল ও প্রাথমিক স্কুল। এই গ্রাম থেকে অনেকেই শিক্ষকতা, অধ্যাপনা বা সরকারি চাকরির সঙ্গে যুক্ত। এ হেন গ্রামে স্রেফ কুসংস্কারে বিশ্বাস রাখার মাসুল দিতে গিয়ে এক জনের প্রাণ গেলএই বিষয়টি ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। বিডিও (জয়পুর) মহম্মদ মারগুম ইলমি বলেন, “ওই গ্রামে শিক্ষার হার বেশ ভাল। তার পরেও এমন কুসংস্কারের ঘটনা রীতিমতো চিন্তায় ফেলেছে আমাদের।” গেলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, তৃণমূলের মনিরুল ইসলাম মিদ্যা বলেন, “আগে কখনও এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়ে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করব আমরা।” ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব দাস ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “যে ওঝারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রত্যেকে খুনি। সকলকে ধরে কড়া শাস্তিদিক সরকার। আমরা শীঘ্রই ওই গ্রামে গিয়ে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করব।”
মৃতার পরিবার, ওঝার দলের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছে। এসডিপিও(বিষ্ণুপুর) জে মার্সি জানিয়েছেন, এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত রাখহরি-সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে এক মহিলাও আছে। বাকিদের খোঁজ চলছে। আজ, সোমবার ধৃতদের বিষ্ণুপুর আদালতে তোলা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy