Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ভোট শান্তিতেই, এজেন্ট শুধু তৃণমূলের

ভোট শুরু সকাল ৭টায়। তার আগে ইভিএম ঠিক মতো কাজ করছে কি না দেখে নিলেন (মক পোল) ভোটকর্মীরা। সাতটা নাগাদ বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের ৪০ নম্বর বুথের তারাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ভোটার হিসেবে আসেন গৃহবধূ সোমা ভাণ্ডারী। তিনি বলেন, “সোমাবার জানতে পারি আমাদের এই বুথে আবার ভোট হচ্ছে। কারণ জানি না। ওই দিন ভোট নির্ভয়ে দিয়েছি। কোনও গণ্ডগোল তো মনে হইনি। ফের ভোট যখন হচ্ছে দিয়ে দিলাম।”

সকাল সকাল বুথে লাইন। মঙ্গলবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

সকাল সকাল বুথে লাইন। মঙ্গলবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

মহেন্দ্র জেনা
ইলামবাজার শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৪ ০০:২২
Share: Save:

ভোট শুরু সকাল ৭টায়। তার আগে ইভিএম ঠিক মতো কাজ করছে কি না দেখে নিলেন (মক পোল) ভোটকর্মীরা। সাতটা নাগাদ বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের ৪০ নম্বর বুথের তারাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ভোটার হিসেবে আসেন গৃহবধূ সোমা ভাণ্ডারী। তিনি বলেন, “সোমাবার জানতে পারি আমাদের এই বুথে আবার ভোট হচ্ছে। কারণ জানি না। ওই দিন ভোট নির্ভয়ে দিয়েছি। কোনও গণ্ডগোল তো মনে হইনি। ফের ভোট যখন হচ্ছে দিয়ে দিলাম।”

শান্তিপূর্ণ ভাবে সকাল সকাল পুননির্বাচন শুরু হল বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের এই বুথে। কেমন ভোট চলছে সকাল সকাল এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, গ্রামে ঢোকার চার কিলোমিটার আগে থেকে পুলিশ এবং প্রশাসনিক তৎপরতা বেশ চোখে পড়ার মতো। মনে হচ্ছিল আশপাশে কোথাও যেন একটা বিরাট গণ্ডগোল হয়েছে। তাই পুলিশ এবং কমব্যাট ফোর্স দিয়ে গোটা এলাকা প্রায় নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলেছেন বোলপুরের এসডিপিও সূর্য প্রতাপ যাদব। ইলামবাজার থানার শীর্ষা পঞ্চায়েতের এই বুথে মোট ভোটার ৩৩৭। নিরাপত্তার যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে সে জন্য এলাকায় হাজির এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব, ইলামবাজারের বিডিও প্রলয়কুমার সরকার, ইলামবাজার ওসি কার্তিক মোহন ঘোষ এবং নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সেক্টর অফিসার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, সহকারি আধিকারিক সাহাবুদ্দিন মোল্লা, প্রিসাইডিং অফিসার মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়-সহ বহু আধিকারিক। কিন্তু কোনও কেন্দ্র বাহিনী ছিল না।

তারাপুর গ্রামে ঢোকার মুখে হাজরাপাড়া। বাড়ির উঠোনে ঝাঁট দিচ্ছিলেন বাড়ির মহিলারা। ভোট দিতে যাবেন না? উত্তর এল ‘একটু দেরি করেই যাব। এই তো দিন দশেক আগে এক বার ভোট দিয়ে এসেছিলাম সকাল সকাল। কী জানি বাপু কী যে হল! সোমবার বিকেলে পার্টির লোকজন এসে বলে গিয়েছে, আবার স্কুলে গিয়ে ভোট দিতে হবে।” ওই পাড়ার ভোটার রঘুনাথ হাজরা বলেন, “আমি তো এই যাচ্ছি ভোট দিতে।” একটু এগোতেই বাগদিপাড়া। ওই পাড়ায় পুনর্নির্বাচনকে নিয়ে খুব একটা যে তাপ-উত্তাপ বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বলে মনেই হল না। দক্ষিণপাড়ায় ঢুকতে না ঢুকতে বাসিন্দা গুরুপদ সৌ, উদয় সৌরা বললেন, “আমাদের পরিবারের সকল ভোটাররা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।”

একই চিত্র তারাপুর গ্রামের পূর্ব ধারে নাপিতপাড়া ঘুরে গ্রামের শেষপ্রান্ত দাসপাড়ায়ও। যে যার নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। বাড়ির পাশে বুথ হওয়ায় ভোটের লাইন জমেছে কি না তা জনতে মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের খোঁজখবর নিতে পাঠাচ্ছেন বড়রা। সকাল সকাল ভোট দিয়ে ফিরতে দেখা গেল দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা সঞ্চিতা সাহা, রূম্পা সাহা, রেবতি মণ্ডলকে। কেমন ভোট দিলেন? জবাব এল, বুথ লাগোয়া একটি আশ্রম প্রাঙ্গণে গ্রামের ২৪ প্রহরের অনুষ্ঠান ছিল। বিকেলে ধুলোট সেরে কোনও মতে রাত দশটা নাগাদ আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই অনুষ্ঠান শেষ করে দিতে হয়েছে। কিন্তু ওই অনুষ্ঠান তো অনেক রাত পর্যন্ত চলে। কোনও মতে শেষ করে দেওয়া হল কেন? তাঁরা বললেন, “শুনলাম ফের ভোট হবে। তাই দ্রুত শেষ করে দিতে হল অনুষ্ঠান।” ওই গ্রামের বাসিন্দা তথা বুথ লাগোয়া নটকোনা দোকানের মালিক ফণীভূষণ পাল জানালেন, তাঁর বয়স ৫৩। তাঁদের গ্রামে কোনও দিন কোনও নির্বাচনে ঝামেলা হইনি। ৩০ এপ্রিল সুষ্ঠুভাবে সকলে ভোট দিয়েছেন। ২৪ প্রহর অনুষ্ঠানের জন্য দুই মেয়ে ও জামাই বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি মজা করে বললেন, “পুলিশ প্রশাসনের যা কড়াকড়ি মঙ্গলবার সকালে সূর্য ওঠার আগেই বড় মেয়ে জামাই ওদের বাড়ি ফিরে গিয়েছে। একটু ফাঁকা পেলেই ভোটটা দিয়ে আসব।” সকাল ৯টা পর্যন্ত ওই গ্রামের ৮৬ জন ভোটারের মধ্যে ৩৩ জন পুরুষ এবং ৫৩ জন মহিলা ভোট দিয়েছেন।

এ দিনের পুননির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় কোনও গণ্ডগোল না হলেও শুধু মাত্র তৃণমূলের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনও দলের এজেন্ট নেই তারাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে। আচমকা সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ ওই বুথে হাজির বিজেপি প্রার্থী কামিনীমোহন সরকার। তিনি বলেন, “বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের ১৯৪০টি বুথের মধ্যে ৫৯২টি বুথে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলাম। এই বুথে দেখছি মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিচ্ছেন। আমি দাবি করে বলতে পারি বোলপুরের সব কেন্দ্রে এমনই যদি ভোট হত তা হলে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস লিড পেত না এবং আমার ধারে কাছে দাঁডাতো না। নির্বাচন তো হইনি। প্রহসন হয়েছে মাত্র। তবে এই কেন্দ্রের চারটি বুথে পুনর্নির্বাচন করে দেখুক নির্বাচন কমিশন।” আপনার দলের কোনও এজেন্ট তো এখানে নেই? এই প্রশ্ন শুনে কামিনীমোহনবাবু বলেন, “মানুষ নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে ভোট দিচ্ছেন। এটাই চাই।” সকাল ১০.১০ নাগাদ বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক শ্রীমতী রাজেশ যাদব হাজির হন ওই বুথে। প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে সেক্টর অফিসার, এসডিপিও সকলের সঙ্গে কথা বলেন। কেমন দেখলেন পুনর্নির্বাচন? জবাব এল, “নির্বাচন কমিশনারকে জিজ্ঞাসা করুন।” বেলা ১১টা নাগাদ ওই বুথে হাজির হন তৃণমূলের প্রার্থী অনুপম হাজরা। তিনি সটান বুথে গিয়ে কেমন চলছে ভোটের কাজকর্ম জেনে নেন পুনর্নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা আধিকারিকদের কাছে থেকে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুথে ভোটারের ঢল কমে গেল। ততক্ষণে অবশ্য পুনর্নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মী আধিকারিকদের জন্য রান্নার কাজ চলছে জোর কদমে। ওই রান্নার তোড়জোড় দেখে সাংবাদিকদের উৎসুকতা দেখে ইলামবাজারের বিডিও এগিয়ে এসে বললেন, “খাওয়াদাওার ব্যাবস্থা কিন্তু আমরা নিজেদের টাকা দিয়ে করেছি।” বিকেল তিনটের মধ্যে ২৩৯টি ভোট পড়ে গিয়েছে। তাদের মধ্যে ১২৫ পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২৭৫। তাদের মধ্যে ১৫৩ পুরুষ এবং ১২২ মহিলা। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ভোটার সংখ্যা ছিল ২৭৯ জন। দিনের শেষে বোলপুর কেন্দ্রের তারাপুর বুথে ৩৩৭ জন ভোটারের মধ্যে ২৭৯ জন ভোট দিয়েছেন। বোলপুর কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৮২.৪১ শতাংশ। অথচ গত ৩০ এপ্রিল বেলা ১১টা নাগাদ ২৩০, বিকেল তিনটে নাগাদ ৩০০, বিকেল পাঁচটা নাগাদ ৩১৯ জন ভোট দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভোট ভোটারের সংখ্যা ছিল একই।

নির্বিঘ্নে ভোট হলেও তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দল কেন এজেন্ট দিল না? সিপিএম, কংগ্রেস এবং বিজেপির নেতারা জানাচ্ছেন, এজেন্ট থাকার কথা ছিল। খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্য দিকে, এই কেন্দ্রের বাকি যে তিনটি বুথে ভোট হয়েছে বর্ধমানের মঙ্গলকোট, আউশগ্রামেও কোথাও আধা সামরিক বাহিনী দেখা যায়নি। মঙ্গলকোটের ১৪ নম্বর বুথ দেবগ্রামে শান্তিতেই ভোট হয়। গ্রামে সিপিএমের পতাকা দেখা গেলেও বুথে কোনও এজেন্ট ছিল না। গ্রামের বাইরে বর্ধমান-শান্তিনিকেতন রোডে কয়েকজন কেন্দ্রীয় বাহিনী দেখা গেলেও তাঁরা গাড়ির মধ্যেই বসেছিল। গত ৩০ এপ্রিলের নির্বাচনে সকাল ৯টার মধ্যে যে বুথে ৮৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল এ দিন সেখানে ওই সময়ে ২৫ শতাংশ ভোট পড়ে। ওই বুথে ভোট পড়েছে ৮০.৭১ শতাংশ। চাকদহ বুথে ভোট পড়েছে ৮৯.৭১ শতাংশ। আউশগ্রামের ২৮ নম্বর বুথে ভোট পড়েছে ৮৩.৩৯ শতাংশ।

সহ প্রতিবেদন: সৌমেন দত্ত।

অন্য বিষয়গুলি:

evm loksabha election ilambazar mahendra jana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE