Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বীরভূমে তালা সমবায় ব্যাঙ্কে, খরিফ মরসুমে বিপাকে চাষিরা

বিঘা ছ’য়েক জমিতে চাষের খরচ চালাতে দুবরাজপুরের তারাপুর গ্রামের বাহামনি মারডি। ১৫ হাজার গত মরসুমে বাঁধেরশোল সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণ শোধও করেছেন। কিন্তু এ বার এক টাকাও কৃষি ঋণ মেলেনি। নানুরের উখরুণ্ডি গ্রামের প্রান্তিক চাষি মিহির ঘোষ, নলহাটির কৈথা গ্রামের লুৎফার রহমানেরও একই দশা।

খয়রাশোলের পারশুণ্ডীতে ধান রোয়ার কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।

খয়রাশোলের পারশুণ্ডীতে ধান রোয়ার কাজ চলছে। —নিজস্ব চিত্র।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৪ ০১:৪৪
Share: Save:

বিঘা ছ’য়েক জমিতে চাষের খরচ চালাতে দুবরাজপুরের তারাপুর গ্রামের বাহামনি মারডি। ১৫ হাজার গত মরসুমে বাঁধেরশোল সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণ শোধও করেছেন। কিন্তু এ বার এক টাকাও কৃষি ঋণ মেলেনি। নানুরের উখরুণ্ডি গ্রামের প্রান্তিক চাষি মিহির ঘোষ, নলহাটির কৈথা গ্রামের লুৎফার রহমানেরও একই দশা। খরিফের মরসুমে চাষের খরচ মেটাতে কোথা থেকে টাকা পাবেন, সেই চিন্তাতেই ঘুম উড়েছে বীরভূমের অন্তত হাজার পঞ্চাশ চাষির।

কেন এই দশা? গত ১৫ মে বীরভূমের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে তালা পড়েছে। ফলে খরিফের মরসুমে জেলার অন্তত হাজার পঞ্চাশেক চাষি ঋণের খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছেন। যাঁরা কৃষি ঋণ নেন না, এমন অনেক চাষি সমবায়ের উপর নির্ভর করেন সারের জন্য। তাঁরাও বিপাকে পড়েছেন।

সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির মাধ্যমে ঋণ নিলে ১০০ টাকায় ৭ টাকা (বার্ষিক) সুদ দিতে হয়। সময়মতো পরিশোধ করলে তা থেকেও ছাড় পাওয়া যায়। মহাজনদের কাছে টাকা ধার নিলে সেই সুদের পরিমাণ প্রতি ১০০ টাকায় ন্যূনতম ৪-১০ টাকা পর্যন্ত (প্রতি মাসে) দিতে হয়। মহাজন ও জোতদারদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের বাঁচাতে একশো বছরেরও আগে ‘ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট’ (১৯১২) অনুসারে স্বল্প সময়ের কৃষি ঋণ দেওয়া শুরু হয়। এ বার চাষিদের ফের মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হবে, আশঙ্কা কৃষি সমবায়ের কর্তাদের। নলহাটি ১ ব্লকের কৈথা সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতির ম্যানেজার মহম্মদ সালেক বলেন, “গত বছর দু’টি মরসুমে প্রায় তিন কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলাম। উপকৃত হন ১০৫০ জন চাষি। এ বার ঋণ বন্ধ।” নলহাটি ২ ব্লকের জ্যেষ্টা হাঁসাপুর সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি থেকে গত মরসুমে ৩৩ লক্ষ টাকা ১৪৫ জন কৃষককে দেওয়া হয়েছিল। এ বার এক জনকেও ঋণ দেওয়া যায়নি। নানুরে চণ্ডীদাস নানুর সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি গতবার ৫৫০ জন কৃষককে ৪৮ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছিল। এই সব সমবায়ের পঁচাশি থেকে ৮৮ শতাংশ চাষি ঋণ শোধ করেছেন। তবু এ বছর ঋণ পাচ্ছেন না তাঁরা। জেলায় এমন অনেক সমিতি রয়েছে, যাদের বয়স ৮০ ছাড়িয়েছে। এক দীর্ঘ ঐতিহ্য থমকে গেল এ বছর।

চাষিদের আরও আশঙ্কা, সমবায় সমিতি অকেজো হওয়ার সুযোগে। সারের কালোবাজারি হবে। সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলির মাধ্যমেই যথাযথ ভর্তুকিতে সার পেতেন চাষিরা। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টাকার অভাবে অনেক সমিতি সার মজুত করতে পারেনি। অনেক সমিতির আমানত জমা ছিল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারার ভয়ে তারা সমিতি খুলে রাখতেই পারছে না। খোলা বাজারে কালোবাজারি হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। বস্তা পিছু সার খোলাবাজারে ১০০-২০০ এমনকী, তার থেকেও চড়া দামে সার কিনতে হবে বলে প্রায় নিশ্চিত চাষিরা।

জেলা উপ-কৃষি অধিকর্তা প্রদীপকুমার মণ্ডল অবশ্য ভরসা দিচ্ছেন, “জেলার চাষিরা যাতে সমস্যায় না পড়েন, তার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড করিয়ে দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই প্রচার শুরু করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকে এই বিষয়ে ক্যাম্প করে কৃষকদের কাছ থেকে আবেদনপত্র নেওয়া হবে।” জেলার লিড ব্যাঙ্ক (ইউকো ব্যাঙ্ক) ম্যানেজার ব্যোমকেশ রায়ও বলেন, “জেলায় অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আধিকারিকদের সঙ্গে এই বিষয়ে বৈঠক হয়েছে। ব্লক কৃষি আধিকারিকেরা আবেদন পাঠালে, যত দ্রুত সম্ভব চাষিদের কার্ড ও ঋণ দেওয়া হবে।”

আধিকারিকেরা যাই বলুন কৃষি দফতরের একাংশের বক্তব্য ও চাষিদের বাস্তব অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলছে। প্রথমত, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে আবেদন করে কিষাণ কার্ড পেতে বেশ কিছু সময় লাগে। সরকারি ব্যাঙ্কের নানা জটিলতা, দীর্ঘসূত্রিতার ভুক্তভোগী বহু চাষি। হাতে বেশি সময় নেই, তাই তাঁরা সরকারি ব্যাঙ্কে যেতে আগ্রহী নন। দ্বিতীয়ত, প্রায় অর্ধেক চাষি সমবায় সমিতিগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার পর শোধ করার সুযোগ পাননি। ফলে তাঁদের জমির নথিপত্র সমিতির কাছ জমা রয়েছে । কৃষি দফতর মারফত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে গেলে, সেগুলোই আগে প্রয়োজন। কিন্তু সেই কাগজ মেলা এখন দূর অস্ত্। ফলে ঋণ পাওয়ারজেলার অধিকাংশ চাষিই তাই মনে করছেন, বাঁচার এখন একটাই পথ কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক খুলে যাওয়া। সমবায় মন্ত্রী জ্যোতির্ময় কর বলেন, “কাজে যোগ দিয়েই এ বিষয়ে বৈঠক করব। চাষিদের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।”

অন্য বিষয়গুলি:

cooperative bank dayal sengupta suiri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE