মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বেশ কয়েক বার পুরুলিয়ায় এসেছেন। সভাও করেছেন। কিন্তু, লোকসভা ভোটের একেবারে মুখে মঙ্গলবার পুরুলিয়ার এমন এক জনপদে সভা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যেখানে শেষ কবে তিনি এসেছিলেন, তা প্রায় মনেই করতে পারছেন না জেলা তৃণমূলের নেতারা।
জনপদের নাম ঝালদা। পুরুলিয়ার জেলার একপ্রান্তে, ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া এই ঝালদাকেই সভা করার জন্য কেন বেছে নিলেন তৃণমূল নেত্রী? জেলা তৃণমূলের একাধিক নেতা আড়ালে মানছেন, “কারণটা হল, নেপাল মাহাতো। পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস এই মানুষটাকে প্রার্থী করে আমাদের সব অঙ্ক ওলটপালট করে দিয়েছে।” ঘটনাও তাই। ঝালদা এবং নেপাল মাহাতো যেন সমার্থক। পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপালবাবুকে লোকসভার টিকিট দিয়ে তৃণমূলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। মানস ভুঁইয়া, আব্দুল মান্নান, শঙ্কর সিংহের মতো পোড়খাওয়া কংগ্রেস নেতারা যখন লোকসভায় লড়ার ব্যাপারে নানা টালবাহানা করছিলেন, তখন নেপালবাবু কিন্তু এক কথায় লড়তে রাজি হয়েছিলেন। হেরে গেলে তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার প্রশ্নের মুখে পড়বে জেনেও।
এ রাজ্যের একাধিক লোকসভা আসনে কংগ্রেস প্রার্থীদের নিয়ে দলের নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও নেপালবাবুর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেসে কোনও প্রশ্ন নেই। তিনি প্রচারও শুরু করে দিয়েছেন জোরকদমে। প্রচারে ভিড় হচ্ছে যথেষ্ট। আর এ সব কারণেই ঝালদাকে সভাস্থল হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী বেছে নিয়েছেন বলে ধারণা জেলা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের। যদিও মুখে জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে বা পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই এলাকায় যাননি। ওখানকার মানুষ তাঁর কথা শুনতে চান। তাই ঝালদায় তাঁর সভা হয়েছে। ভোটের আগে জেলার অন্যত্রও তাঁর সভা হবে।”
শান্তিরামবাবু এ কথা বললেও অনেক তৃণমূল নেতার স্বীকারোক্তি, “বিদায়ী ফরওয়ার্ড ব্লক সাংসদ নরহরি মাহাতো নন, বিজেপি প্রার্থীও নন। এখানে আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বলুন বা মাথাব্যথাই বলুন, সব ওই নেপাল মাহাতো!” তৃণমূলের এই অংশের আশঙ্কা, বাঘমুণ্ডির বিধায়ক নেপালবাবু যদি তাঁর নিজস্ব প্রভাবে প্রচুর ভোট কেটে নেন, তাতে তৃণমূলেরই বাড়া ভাতে ছাই পড়তে পারে। জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রথীন্দ্রনাথ মাহাতোর দাবি, “নেপালবাবুকে প্রার্থী করায় কংগ্রেসের পালে যে হাওয়া উঠেছে, তা দেখে তৃণমূল ভয় পাচ্ছে। সে জন্যই জেলা তৃণমূল মুখ্যমন্ত্রীকে এমন এক প্রত্যন্ত জায়গায় আনিয়ে সভা করিয়েছে।”
নেপাল মাহাতোর ‘গড়’ হিসেবে পরিচিত সেই ঝালদা থেকে সাত কিলোমিটার দূরে, ঝালদা ২ ব্লকের সদর কোটশিলা এলাকার ডাকবাংলো ময়দানের ভরা সভাস্থল দেখে কিন্তু খুশিই হয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। মঞ্চে উঠেই তিনি বলেন, “ব্রিগেডের থেকেও বড় মাঠ। অনেক আদিবাসী মহিলা এখানে এসেছেন। পুরুলিয়া খুব গরম জেলা। তার মধ্যেও আপনারা এসেছেন। ধন্যবাদ।” পুলিশের হিসেবে সভায় ভিড় হয়েছিল ৫০-৬০ হাজার। কিন্তু তৃণমূল সূত্রেই খবর, শুধু এই লোকসভা কেন্দ্র নয়, লোক আনা হয়েছে কার্যত সারা জেলা থেকেই।
মুখ্যমন্ত্রী বা সভার অন্য বক্তারা নেপালবাবুকে সরাসরি আক্রমণও করেননি। করেছেন তাঁর দল কংগ্রেসকে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “কংগ্রেসকে ভোট দেবেন না। ওরা পেট্রোল, ডিজেল, সার, গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। খেতে দেয় না। শুধু পার্টি ফান্ড গড়ে। আমরা ঝাড়খণ্ড সীমানার এই জেলাকে সাজাচ্ছি।” ঝালদার এই অংশে ভোটারদের একটা বড় অংশ বিড়ি শ্রমিক। এই তথ্য মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, স্থানীয় বিড়ি শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে যাতে আর হয়রান না হতে হয়, তা দেখা হচ্ছে।
অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া এই এলাকা একটা সময়ে মাওবাদীদের কার্যত মুক্তাঞ্চল ছিল। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলের শান্তি নষ্ট করতে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কারসাজি করার অভিযোগও তুলেছেন। তিনি বলেন, “টাকার দাবি করা হচ্ছে, ভোট বয়কট করা হবে বলে ভয় দেখানো হচ্ছে। ভয় দেখালে এফআইআর করুন। প্রশাসনের কাছে যান। এ সব সিপিএম, কংগ্রেসের কারসাজি। বসে বসে ওরা অভিযোগ করছে আর রাতে অন্ধকারে ভয় দেখাচ্ছে।”
ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ঝালদা-জয়পুর-বাঘমুণ্ডি বরাবর কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ঝালদার ইচাগ গ্রামে বাড়ি নেপালবাবুর। এই তিন অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় বামফ্রন্টেরও প্রভাব রয়েছে। এখানে এখনও সে ভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূল। গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের ওই ঝড়ের মধ্যেও এই তিন এলাকায় তারা একক ভাবে লড়াই করে খুব একটা ফায়দা তুলতে পারেনি। বাঘমুণ্ডি ও ঝালদা ১ পঞ্চায়েত সমিতির পাশাপাশি ওই দুই ব্লকে জেলা পরিষদের সব আসন কংগ্রেসের দখলে যায়। ঝালদা ২ পঞ্চায়েত সমিতি পায় বামফ্রন্ট। তৃণমূলের প্রাপ্তি বলতে শুধু ঝালদা ২ ব্লকে জেলা পরিষদের একটি আসন। আর বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত তারা পেয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থল বাছা নিয়ে অবশ্য সরাসরি কিছু বলতে চাননি নেপালবাবু। তাঁর মন্তব্য, “যে কারওর যেখানে খুশি সভা করার অধিকার আছে। তবে, মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু তিন বছরেও এই জেলার হাসপাতালে আইসিসিইউ করতে পারেননি।”
সভায় ভিড় প্রসঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, “এ দিন তো সারা জেলা থেকে সভায় লোক ধরে আনা হয়েছিল। অধিকাংশ লোক কিন্তু এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর চপার দেখতে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy