আকাশ ভেঙে নামে শিলাবৃষ্টি। হুড়ার লালপুরে অ্যাসবেসটসের চালা ফুটো হয়ে গিয়েছে।
বিকেল থেকে গোটা জেলা জুড়েই ছিল আকাশের মুখ ভার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া চলছিল পুরোদমে। সন্ধ্যে হতেই শিলাবৃষ্টি নামল দক্ষিণ বাঁকুড়ার সিমলাপাল ও খাতড়া ব্লকে। বুধবারের ওই শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এই দুই ব্লকের শতাধিক মানুষ। অনেকেই মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছেন। যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে চাষেরও। যদিও এই ঘটনায় প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। খাতড়ার মহকুমাশাসক অভিষেক তিওয়ারি বলেন, “শিলাবৃষ্টিতে সিমলাপালে বেশ কিছু ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে বলে রিপোর্ট এসেছে। খাতড়াতেও শিলাবৃষ্টি হয়েছে বলে শুনেছি। তবে সেই রকম একটা ক্ষয়ক্ষতির খবর আসেনি।”
জেলা আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, বুধবার রাতে বাঁকুড়ায় বৃষ্টি হয়েছে ৩.৯ মিলিমিটার। উত্তর ও দক্ষিণ বাঁকুড়ার নানা ব্লকে বৃষ্টি হলেও শিলাবৃষ্টি হয়েছে কেবল সিমলাপাল ও খাতড়ায়। সিমলাপালের স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বুধবার সন্ধ্যায় আধঘণ্টার মধ্যে দু’দফায় প্রায় ২০ মিনিট শিলাবৃষ্টি হয়েছে। শিলাখণ্ডগুলির আকার ছিল বেশ বড়। সিমলাপাল ব্লক সদরের পাশাপাশি লক্ষ্মীসাগর, ভালাইডিহা, কানকাটা, দুবরাজপুরের মতো একাধিক গ্রামে শিলাবৃষ্টি হয়েছে। সিমলাপালের বিডিও সৌম্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ত্রাণের জন্য প্রায় ২৫০ জন মানুষ ব্লক অফিসে আবেদন করেছেন। যদিও সিমলাপালের বাসিন্দা তথা জেলা যুব তৃণমূলের নেতা শীতল দে-র দাবি, কয়েক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শিলাবৃষ্টির জেরে। বহু জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। অনেকেই ব্লক অফিসে না গিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতেও ত্রাণের আবেদন করেছেন।
সিমলাপালে চাষেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সিমলাপালের ধানখুনিয়া গ্রামের জাহানারাবিবি ভাঙি বলেন, “আমাদের টিনের চালার বাড়ি। বুধবার বিকেল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎই দুমদাম শব্দে শিলা পড়া শুরু হল। আমরা ভয়ে ঘরের কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিনের চালা ভেঙে শিলা বাড়ির ভিতরে পড়তে শুরু করল।” তিনি জানান, চালা ভেঙে যাওয়ার পরে কেউ লেপ, কেউ কাঁথা মাথায় দিয়ে কোনও রকমে শিলার আঘাত থেকে বেঁচেছেন। ব্লক অফিসে ত্রাণের আবেদন করতে এসে একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন সিমলাপালের কানকাটা গ্রামের বাসিন্দা মমতাবিবি খাঁ, চরাবেদ্যার সখিয়াবিবি মণ্ডল, দুবরাজপুরের চণ্ড মান্ডি। সিমলাপালের মাধবপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের প্রায় সব ক’টি টিনের চালার বাড়ির ছাদই শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এই গ্রামের বাসিন্দা রবি মুর্মু বলেন, “কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছি। দু’বার শিলাবৃষ্টি হওয়ার পরে গোটা রাত আতঙ্কে কেটেছে আমাদের।” গ্রামের বধূ গুরুমণি মুর্মুর কথায়, “নিমেষের মধ্যে ঝাঁঝরা হয়ে গেল টিনটা! ভয়ে দৌড়ে বারান্দায় চলে যাই।” গ্রামবাসী স্বপন সরেন বলেন, “ধার করে কয়েক কাঠা জমিতে আমরা কয়েক জন আলু লাগিয়েছিলাম। শিলাবৃষ্টিতে ফসল মাঠেই মারা গেল। আমার মতো অনেকেরই মাথায় হাত পড়েছে।” খাতড়া মহকুমার সহ কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) প্রবীণ মিশ্র জানিয়েছেন, সিমলাপাল ব্লকে শিলাবৃষ্টিতে শীতকালীন সব্জির পাশাপাশি গমেরও ক্ষতি হয়েছে। তবে, এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা সরকারি নিয়ম মাফিক ক্ষতিপূরণ পাবেন।
সিমলাপালের পাশাপাশি খাতড়া ব্লকের সুপুর, বৈদ্যনাথপুর, ধানাড়ার মতো বেশ কিছু গ্রামেও শিলাবৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে। খাতড়া ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তা মনোজ মুর্মু জানান, সুপুর, দহলা, ধানাড়া ও বৈদ্যনাথপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ১৮টি মৌজায় বেশ কয়েক বিঘা জমিতে শীতকালীন সব্জি ও গম চাষ আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিলাবৃষ্টিতে। বাঁকুড়া জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ শ্যামল সরকার বলেন, “খাতড়া ব্লকে ঘরবাড়ি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে শুনিনি। তবে চাষের ক্ষতি হয়েছে। কৃষি দফতরকে পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে।”
বুধবার বিকেলের আচমকা ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতির খবর এসেছে পুরুলিয়ার চারটি ব্লক থেকেও। বুধবার কাশীপুর, হুড়া, পাড়া ও পুরুলিয়া ২ ব্লক এলাকা জুড়েই শিলাবৃষ্টি হয়। টালি ও অ্যাসবেস্টসের বাড়ির চাল এবং মাঠের সব্জির ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। বৃহস্পতিবার হুড়ার বিডিও-র কাছে এলাকার বাসিন্দারা ক্ষতিপূরণের দাবিতে স্মারকলিপিও দেন। অমিতকুমার গোস্বামী, ঠান্ডা মুদি, ব্রজবালা মুদি, কালাচাঁদ মণ্ডলরা জানান, শিলাবৃষ্টিতে তাঁদের বাড়ির চালা পুরো ভেঙে গিয়েছে। আলোক মণ্ডলের কথায়, “আমি দুধের ব্যবসা করি। গোয়ালঘর, রান্নাঘর ও আর একটা ঘরের চালা ভেঙেছে শিলার ঘায়ে।” তিলগোড়া গ্রামের চাষি স্বপন মাঝির হতাশা, “আমি টম্যাটো চাষ করেছিলাম। মাঠে প্রায় ১৩০০ গাছ ছিল। শিলায় বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।” হুড়ার যুগ্ম বিডিও অশোককুমার রক্ষিত বলেন, “বাসিন্দাদের আবেদনের ভিত্তিতে খতিয়ে দেখে ত্রাণ সাহায্য দেওয়া হবে।” কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া বলেন, “সিমলা-ধানাড়া, সোনাইজুড়ি, হদলদা-সহ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সব্জি, গম ও সর্ষে চাষের ক্ষতি হয়েছে। উদ্যান পালন দফতর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খতিয়ে দেখছে।” জেলা উদ্যান পালন দফতরের এক আধিকারিক সুদীপ ভগত জানান, ওই চারটি ব্লক থেকেই পেঁয়াজ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, পালং-সহ নানা সব্জির ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলেছে।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy