বিজেপি-র উত্থানে অশনি-সঙ্কেত দেখছে তৃণমূল, সিপিএম দু’দলই। গত ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি-র ভোটপ্রাপ্তি শতাংশের হিসাবে ছিল চারের মতো। আর এ বার মোদী-হাওয়ায় ভর করে সেটাই বেড়ে হয়েছে ২০.৩১ শতাংশ। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ বার প্রায় ছ’গুণ বেশি ভোট পেয়েছে বিজেপি।
বিজেপি ভোট কেটে নেওয়ায় বাঁকুড়ার টানা ন’বারের সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়াকে যেমন এ বার হারতে হয়েছে, তেমনই খাস বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএমকে টপকে বিজেপি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ঘুম কেড়ে নিয়েছে তৃণমূলেরও। আবার কার্যত কোনও প্রচার ছাড়াই বিষ্ণুপুর পুরসভার তিনটি ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপি। বস্তুত, দেশ জুড়ে বইতে থাকা মোদী ঝড়ের উপর ভর করে বাঁকুড়াতেও যে বিজেপি-র ভোট বাড়তে চলেছে, তা আগেই মেনে নিয়েছিলেন সিপিএম এবং তৃণমূল নেতৃত্ব। বিজেপি প্রার্থী কতটা ভোট কাটবেন, তা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগেও ছিল তৃণমূল শিবির। পাশাপাশি, বাঁকুড়ার স্কুলডাঙায়, সিপিএমের জেলা কার্যালয়ের দোতলার এসি কামরাতেও রোজ চলছিল সেই কাটাছেঁড়ার হিসেব মেলানোর খেলা। সিপিএম নেতাদের ব্যাখ্যা ছিল, তৃণমূলের তারকা প্রার্থী মুনমুন সেনকে জেলার বহু নেতাই মেনে নিতে পারেননি। তার ফায়দা পাবে সিপিএম-ই।
সব হিসেব উল্টে গেল ১৬ তারিখ। ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, তৃণমূলের তুলনায় অনেক বেশি ভাগ হল বিরোধী সিপিএমের ভোট। গত লোকসভায় বাঁকুড়া কেন্দ্রে যে দল সর্বসাকুল্যে প্রায় ৪০ হাজার ভোট পেয়েছিল, এ বার সেখানে তাদের প্রাপ্ত ভোট আড়াই লক্ষ ছাড়িয়ে গেল! শুধু বাঁকুড়া কেন্দ্রেই নয়, বিজেপি ছাপ ফেলেছে জেলার আর এক লোকসভা কেন্দ্র বিষ্ণুপুরেও। ২০০৯ সালে এই কেন্দ্রেও টেনেটুনে ৪০ হাজার ভোট পেয়েছিল বিজেপি। এ বার সেখানে সাদামাটা প্রচারেই তারা ভোট পেয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার। যার কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পাচ্ছেন না জেলার রাজনৈতিক কারবারিরা।
বিধানসভা ভিত্তিক ফলে চোখ রাখলেই বিজেপি-র চোখধাঁধানো সাফল্য ধরা পড়ছে। বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল এক সময় সিপিএমের গড় বলেই পরিচিত। গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রবল মমতা হাওয়াতেও বামেদের সেই ভিত নড়েনি। দক্ষিণ বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, রাইপুর ও তালড্যাংরা বিধানসভা কেন্দ্র থেকেছে বামেদের হাতেই। অথচ এই সব এলাকাতেও এ বার বামেদের ভোট কেটে গিয়েছে বিজেপির ভাঁড়ারে। যেমন, গত বিধানসভা ভোটে রানিবাঁধ কেন্দ্রে সিপিএম পেয়েছিল ৭৫,৩৮৮ ভোট। এ বার এই বিধানসভা থেকে তাদের প্রাপ্ত ভোট ৫৪,৭৬৯। অন্য দিকে, এই কেন্দ্রে বিজেপি গত বিধানসভায় পেয়েছি ৬,৪৪৭ ভোট। এ বার তাদের প্রাপ্তি ৩৬,১৬২!
তবে, শুধুই যে সিপিএমের ক্ষতি হয়েছে, এমন নয়। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাচ্ছে, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে জঙ্গলমহলের দু’টি বিধানসভা আসন (রাইপুর, রানিবাঁধ) ছাড়া বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত আরও চারটি বিধানসভা আসনের (শালতোড়া, ছাতনা, বাঁকুড়া ও রঘুনাথপুর) সব ক’টিতেই ভোট কমেছে তৃণমূলেরও। উল্টো দিকে হু হু করে বেড়েছে বিজেপি-র ভোট প্রাপ্তি। বিজেপি সবচেয়ে চমকপ্রদ ফল করেছে খাস বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে। তিন বছর আগের বিধানসভা ভোটে এখানে তৃণমূল পেয়েছিল ৯২ হাজার ৮৩৫ ভোট। এ বার লোকসভা নির্বাচনে ওই কেন্দ্রে শাসকদলের ভো প্রায় ২০ হাজার কমে গিয়েছে! সিপিএমের ভোট ৬৩ হাজার ৭৪৫ থেকে কমে হয়েছে ৪৬ হাজার ১৬৬। অন্য দিকে, বিজেপি-র ভোট ৫ হাজার ৭৭২ থেকে প্রায় দশ গুণ বেড়ে ৫১ হাজার ১৭২ হয়েছে। আর তার জেরে বিজেপি এই কেন্দ্রে সিপিএমকে তিন নম্বর স্থানে ঠেলে দিয়েছে।
পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর বিধানসভাতেও বিজেপি-র ভোট কাটায় সিপিএমের চেয়ে বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে রাজ্যের শাসক দলের। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বিধানসভা নির্বাচনে রঘুনাথপুরে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৭৮,০৯৬টি। এ বার লোকসভায় ওই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৬১,৫৫১টি। অর্থাত্, ১৬,৫৪৫ ভোট কমেছে তৃণমূলের। সেই তুলনায় বামেদের ভোট কমেছে তৃণমূলের প্রায় অর্ধেক (প্রায় ৮ হাজার কমেছে)। বিধানসভা সিপিএম প্রার্থী এখানে পেয়েছিলেন ৬৫,৩৫৩টি ভোট। আর এ বার বাসুদেব আচারিয়া রঘুনাথপুর থেকে পেয়েছেন ৫৭,০৪৭। এই তিন বছরে বিজেপি রঘুনাথপুর বিধানসভা এলাকায় তাদের ভোট বাড়িয়ে নিয়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি (৭,৯১৬ থেকে এ বার ৪৩,০৮১)! এক কথায়, রঘুনাথপুরে বামেদের তুলনায় তৃণমূল নেতৃত্বের কপালেই বেশি ভাঁজ ফেলেছে বিজেপি। তাদের ভোট কাটার সৌজন্যে এখানে তৃণমূলের ‘লিড’ তিন বছর আগের তুলনায় দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ হাজারে।
ফল ঘোষণার পরেই বুথ ভিত্তিক ফল নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে তৃণমূল শিবিরে। তাতে জানা যাচ্ছে, রঘুনাথপুর বিধাসভায় লিড কমাই শুধু নয়, অন্তত পাঁচ-ছ’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের দখলও লোকসভার ফলের নিরিখে হারাচ্ছে তৃণমূল। নিতুড়িয়ায় দলীয় বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরির বাড়ি সড়বড়ি এলাকার একটি বুথে তৃণমূল বিজেপি-র চেয়ে মাত্র আট ভোটে এগিয়ে রয়েছে। রঘুনাথপুর বিধানসভার ২৬৮টি বুথের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ বুথে পিছিয়ে পড়েছে তৃণমূল।
ফল আশানুরূপ হয়নি মানলেও, বিধায়ক পূর্ণচন্দ্রবাবুর দাবি, “এ বার ভোট হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতিতে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে কুত্সা ও বিজেপি-র সমর্থনে সংবাদমাধ্যমের একাংশের লাগাতার প্রচার এবং মোদী হাওয়ার রেশ পড়েছে কিছু সংখ্যক ভোটারের মনে। তবে আমরা বুথ ধরে সমীক্ষা করে আমাদের ক্ষত মেরামত করে নিতে সমর্থ।”
বস্তুত যে কথাটি তৃণমূল মুখে বলছে না, তা হল আসানসোলে বিজেপি-র বিশাল জয়ের প্রভাব পড়েছে পাশের রঘুনাথপুরে। তার উদাহরণ দামোদরের ঠিক পাশেই নিতুড়িয়ার পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি শান্তিভূষণ প্রসাদ যাদবের খাসতালুক শালতোড় পঞ্চায়েতে লোকসভা ফলের নিরিখে বিজেপি-র কাছ খুইয়েছে তৃণমূল।
সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেন, “বিজেপি শাসক-বিরোধী, দু’পক্ষেরই ভোট কেটেছে। তুলনায় আমাদের ভোট বেশি কাটলেও শাসক দলও ক্ষতির মুখে পড়েছে।” বাঁকুড়ায় জিতলেও বিজেপি-র বাড়বাড়ন্তে স্বস্তিতে নেই শাসক দল। বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের কো-চেয়ারম্যান তথা জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর বক্তব্য, “কেন আমাদের ভোট কমল, তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে। তবে এই ভোটে সিপিএম বিজেপি-কে দিয়ে আমাদের ভোট কাটার যে ‘গেম’ খেলতে চেয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। উল্টে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
রাজ্যে বামেদের মাত্র দুই আসনে জয় কিন্তু অরূপবাবুর বক্তব্যকেই সমর্থন করছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy