জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের মঞ্চ বাঁধা চলছে। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।
মাতৃভাষার দাবিতে মানভূমের গণ-আন্দোলনকে ভুলে গেল রাজ্য সরকার! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে এমনটাই আক্ষেপ করছেন পুরুলিয়ার ভাষা-আন্দোলনের সেনানীরা। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে এ বারও ডাক পেলেন না জেলার ভাষা কর্মীরাই!
আজ ২১ ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে, অন্য জায়গার মতো স্মরণ অনুষ্ঠানে মাতছে পুরুলিয়াও। শনিবার ভাষা দিবসের নানা অনুষ্ঠান পালিত হবে সরকারি উদ্যোগে। অথচ, জেলার ভাষা আন্দোলনের কর্মীরা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পাননি। ভাষা কর্মীরা সরাসরি কোথাও কোনও অভিযোগ জানাননি। তাঁদের একাংশের অনুযোগ, “জেলার ভাষা কর্মীদের বাদ দিয়ে এমন ধরনের অনুষ্ঠান করছে জেলা প্রশাসন!”
জেলার তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক মানসী মণ্ডল বলেন, “সরকারি ভাবে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া দফতরের রঘুনাথপুর মহকুমা অফিসেও পৃথক ভাবে অনুষ্ঠান করা হবে। আমি জেলায় নতুন এসেছি। এই জেলায় যে সব ভাষা কর্মী আছেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যোগাযোগ করতে পারিনি।”
বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে পুরুলিয়া তথা মানভূম জেলার ভাষা আন্দোলনের সরাসরি কোনও যোগ নেই। পুরুলিয়ায় ভাষা কর্মীদের একাংশের ক্ষোভ, মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলা আন্দোলনের জেরে পুরুলিয়া জেলার জন্ম হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে, জেলার সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে চর্চা হলে হয়তো বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে। একইসঙ্গে জেলার ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকা কর্মীদের অবদানকেও মর্যাদা দেওয়া হবে।
বাংলা ভাষার জন্য সে দিনের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি এখনও উজ্বল ভাষা-সেনানীদের কাছে। মানভূম জেলার ভাষা আন্দোলন সব থেকে পুরনো। মানভূম জেলা অবিভক্ত বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ আইন প্রণয়ন করেছিলেন। সেই সময় মানভূম জেলাকে বিহার রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনের চাপে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ হলেও, মানভূম জেলাকে বিহার থেকে আর বাংলায় ফিরিয়ে আনা হয়নি। তখনই মানভূম জেলায় ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বোরো থানার রাঙামেটা গ্রামের নকুল মাহাতো, ভূতনাথ মাহাতো, কেন্দা থানার পানিপাথর গ্রামের নারায়ণ মাহাতো, পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রামের পূর্ণচন্দ্র মাহাতোরা বলছিলেন সেই সব দিনের কথাই। তাঁদের কথায়, “বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে সম্মান দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ যেমন আন্দোলন করেছিল, আমরাও বিহার সরকারের বাংলা ভাষা দমনের বিরুদ্ধে ততটাই সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু সে সব কথা এখন না নতুন প্রজন্ম জানে। না এই সরকার সে দিনের কথা স্মরণ করতে চায়। আমাদের আন্দোলন উপেক্ষার শিকার।”
কংগ্রেসের জাতীয় নেতাদের অনুরোধে স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পর মানভূম জেলা পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভূক্ত না হওয়ায় ১৯৪৮ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে জেলার নেতারা মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে গণ-আন্দোলন শুরু করেন। জেলার ইতিহাস গবেষক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “কেউ মারা না গেলেও আন্দোলনকারীদের অনেকেই বেঘর হয়েছিলেন। মিথ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছিল। কেউ কেউ কাজ খুইয়েছিলেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে পুঞ্চার পাকবিড়রা ময়দান থেকে লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বে ১,০২৫ জন সত্যাগ্রহী কলকাতার উদ্দেশো পদযাত্রা করেন। সেই আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মানভূম জেলার খণ্ডিত অংশ পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গে নবতম জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।”
ভাষা সেনানী নকুল মাহাতো, ভূতনাথ মাহাতো, পূর্ণচন্দ্র মাহাতোরা বলেন, “ওই ঐতিহাসিক পদযাত্রায় হেঁটে কলকাতা গিয়েছিলাম। বেশিরভাগ ভাষা কর্মী বয়সের ভারে প্রয়াত হয়েছেন। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে আজ অবধি আমাদের কোথাও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি!”
লোকসেবক সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো বলেন, “২০০৬ সালে বাম আমলে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাকবিড়রায় জেলার পঞ্চাশতম জন্মদিনে ভাষা আন্দোলনের স্মারক সৌধের উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। অসমাপ্ত সৌধ এখনও পড়ে রয়েছে। তৃণমূল সরকারও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে উপেক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে। জেলায় কতজন ভাষা কর্মী বেঁচে আছেন, ওই তালিকা আমাদের কাছে নেই। তবে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে ভাষা কর্মীরা আমন্ত্রিত হবেন এটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল।” ভাষা সেনানীদের আক্ষেপ, ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে রাজ্য সরকার যতটা মাতামাতি করে, তার শতাংশও পুরুলিয়ার ভাষা আন্দোলনের স্মরণে ১ নভেম্বর করা হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy