চাই পরিকল্পিত বাজার। এ ভাবেই বিপজ্জনক ভাবে রেল লাইনে বসে বাজার। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
সকাল ৯টা ৪২। রামপুরহাট-কাটোয়া প্যাসেঞ্জার সবে মাত্র লোহাপুর স্টেশনে থেমেছে। ঠিক এক মিনিটের মাথায় ট্রেন ছেড়েও দিল। পরের স্টেশন মোড়গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য বার বার হুইসেল দিচ্ছে। বার বার কেন?
স্টেশনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে মিলল উত্তর। ট্রেন এগোবে কি করে? নলহাটি–আজিমগঞ্জ লাইনে মোড়গ্রামের দিকে প্রায় ১০০ মিটার জুড়ে কয়েক শতাধিক লোক দাঁড়িয়ে বসে। রমরমিয়ে চলছে হরেক রকম বিকিকিনি। লাইনের উপর গড়াচ্ছে লাউ, কুমড়ো, কচু, ঢ্যাঁড়শ। রেললাইনে পড়ে খাবি খাচ্ছে রুই, মৃগেল, কাতলা। শুধু মাছ নয়, মাছ ধরার ছিপ-বঁড়শি, ফাতনাও দেদার বিকোচ্ছে। লাইনের উপরই দাঁড়িয়ে অনেকে দর করছেন ছেনি, হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভারের। কেউ কেউ আবার ভিড় করেছেন পেটের রোগের ওষুধ-বিক্রেতার সামনে। ভিড় উপচে পড়ছে চিরুনি, ফিতে, আয়নার দোকানেও।
সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন নয়, প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে দপুর তিনটে পর্যন্ত চলছে এই লোহাপুর সব্জি হাট। হাট আর কোথায়? আস্ত বাজার। উৎসবের মরসুমে তা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্তও চলে। রেললাইনের উপর ঝুঁকির এই বাজারের ভিড় ট্রেন এলে অভ্যেস মাফিক চটজলদি সরে যায়। বিক্রির জিনিস পড়ে থাকে মাঝ লাইনেই। ক্রেতাদেরও বাজারে এসে বর্ষার সময় রেললাইনের ধারে কাদায় পা ডুবে যায়। কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। নলহাটি ২ ব্লকের ছ’টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বারা ১, বারা ২, ভদ্রপুর ২, নওয়াপাড়া এই চারটি পঞ্চায়েতের অধিকাংশ বাসিন্দা লোহাপুর বাজার করেন।
সম্প্রতি রেললাইন সম্প্রসারিত হয়েছে, লোহাপুর হল্ট স্টেশনেরও উন্নতি হয়েছে। কিন্তু ট্রেনের সংখ্যা বাড়েনি। মালগাড়ির যাতায়াতেও নাই। তবে ট্রেন না বাড়লেও লোহাপুর স্টেশনের উপর দিয়ে হাওড়া–আজিমগঞ্জ গণদেবতা এবং কবিগুরু দুটি এক্সপ্রেস যাতায়াত করে। লোহাপুরে তাদের স্টপেজ নেই। সব্জিবাজার যখন বসে, তখন গণদেবতা এক্সপ্রস আজিমগঞ্জ যায়, অন্যদিকে কবিগুরু এক্সপ্রেস হাওড়ার দিকে যায়। দুটি গাড়ি লোহাপুর হল্ট স্টেশনের উপর দিয়ে তুলনায় কম স্পিডে যাতায়াত করে। আবার রামপুরহাট-আজিমগঞ্জ প্যাসেঞ্জার ট্রেন, রামপুরহাট-কাটোয়া প্যাসেঞ্জার এই সমস্ত ট্রেনগুলিকেও গতি কমিয়ে যেতে হয়। সতর্ক থাকতে হয় চালকদের।
লোহাপুরের বাসিন্দা অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মী আতিউর রহমান বলেন, ‘‘বয়স হয়েছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাজার করি।’’ একই কথা বলছিলেন, লোহাপুরের গোলাম হোসেন। ‘‘অনেকদিন আগে লোহাপুরে সব্জি বাজার বসত ভিতরের দিকে। এখন সেখানে ঘরবাড়ি হয়ে গিয়েছে সেই জন্য ওখানে বাজার বসে না।’’ এলাকার বাসিন্দা মমিনুল হক, বিক্ষয় মাল আব্দুল খালেকরা জানালেন, বছর পঁচিশ আগে এলাকার বাসিন্দা রাজেন ভকত সব্জি বাজার রেললাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের জায়গায় কুড়িটি পাকা ঘর তৈরি করে দেয়। সেখানে একমাসেরও কম দিন সব্জি বাজার বসার পর আবার একই অবস্থা ফিরে আসে। পরে আর এক স্থানীয় বাসিন্দা লোহাপুর স্টেশন ছাড়িয়ে পঁচিশটির বেশি ঘর করে দিলেও সেখানেও সব্জি বাজার উঠে যায়নি।
কেন রেললাইন ছেড়ে নতুন জায়গায় বাজার উঠে যায়নি?
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ‘‘সব্জি হাটের ব্যবসায়ীরা ভাড়া দিয়ে বাজার করতে চায় না। সেইজন্য রেললাইনের উপর বাজার বসিয়ে দিব্যি বিনাপয়সায় বছরের পর ব্যবসা করছে।’’ সদুত্তর মেলে না বাজারের বিক্রেতাদের জিজ্ঞাসা করেও। কেউ বলেন, ‘‘বেশি দিন করছি না’, কেউ বলেন, ‘‘বছর খানেক থেকে ভাড়া নিয়ে অন্যের দোকান চালাচ্ছি।’’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘‘সবাই সরলে আমিও সরব।’’
এতদিন ধরে রেল লাইনের উপর অবাধে বাজার চলছে, রেল পুলিশের ভূমিকা কী? রেল পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কর্তব্যরত স্টেশন ম্যানেজার এবং রেল সুরক্ষা বাহিনীর এটা দেখা উচিত।’’ লোহাপুর হল্ট স্টেশনের রেলের এরিয়া ম্যনেজার শান্তনু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘লোহাপুর স্টেশনের উপর দিয়ে গিয়েছি। মাঝে মধ্যে রেলপুলিশ দিয়ে স্টেশনের উপর থেকে হকারদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রেল লাইনের উপর সব্জি বাজার বসা নিয়ে আমার খুব একটা জানা নেই। তবে একবার সরজমিন তন্দন্ত করে দেখে অবশ্যই রেললাইন থেকে বাজার সরানোর জন্য কতৃর্পক্ষের নজরে আনব।’’
রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনীর নলহাটি ইনচার্জ ভগবান সন্তরাম বলেন, ‘‘লোহাপুরে রেললাইনের উপর সব্জিবাজার বসে এটা আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy