Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

দু’টি প্রাণ হারিয়ে সুরক্ষার আশ্বাস

বুধবার বিকেলে খেলতে গিয়ে ছাইপুকুরে তলিয়ে গিয়েছিল ছাইপুকুর লাগোয়া কচুজোড় গ্রামের  তিন ছোট ছেলেমেয়ে। এক জনকে কোনও ক্রমে বাঁচানো গেলেও প্রাণ গিয়েছে ভাইবোন সাথী পাল (৫) ও রাজীব পালের (১৩)।

ছাইপুকুরে তলিয়ে মৃত রাজীব পাল ও সাথী পাল। নিজস্ব চিত্র

ছাইপুকুরে তলিয়ে মৃত রাজীব পাল ও সাথী পাল। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বক্রেশ্বর শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২২
Share: Save:

বোনের দেহ মিলেছিল বুধবার সন্ধ্যায়। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই পুকুর থেকে বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধার হল তার জেঠতুতো দাদার দেহ। আর এই দুই প্রাণের বিনিময়ে টনক নড়ল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের। আশ্বাস মিলল, ছাইপুকুরে যাওয়া ঠেকানোর।

বুধবার বিকেলে খেলতে গিয়ে ছাইপুকুরে তলিয়ে গিয়েছিল ছাইপুকুর লাগোয়া কচুজোড় গ্রামের তিন ছোট ছেলেমেয়ে। এক জনকে কোনও ক্রমে বাঁচানো গেলেও প্রাণ গিয়েছে ভাইবোন সাথী পাল (৫) ও রাজীব পালের (১৩)। সন্তান হারিয়ে শোকস্তব্ধ দুই শিশুর পরিবার। তরতাজা দু’টি ছেলেমেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুতে কালীপুজো, দীপাবলির আগে শোকের ছায়া গ্রাম জুড়ে। প্রশ্ন উঠেছে ছাইপুকুরে নিরাপত্তা না থাকা নিয়েও।

সদাইপুর থানা এলাকার কচুজোড় গ্রামের বাসিন্দারা এ দিন জানান, গ্রাম ঘেঁষে তৈরি হয়েছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ছাইপুকুর। এই সময় ছাই মিশ্রিত প্রচুর জল পুকুরে। অনেকটা জলাধারের মতো দেখতে। সেই টানে সকাল সন্ধ্যা গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা প্রায় ৩০ ফিট উঁচু ছাই পুকুরের পাড়ে উঠে। কিন্তু কংক্রিটের ঢালযুক্ত ওই পুকুর ভযঙ্কর বিপজ্জনক। গ্রামবাসীদের ক্ষোভ, ‘‘তাপবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ফেন্সিং কিংবা সতর্কীকরণ বোর্ড নেই। যে কেউ পুকুরে তলিয়ে যেতে পারে। যেমনটা ঘটল বুধবার।’’

আবার এমন ঘটবে না তো— বুধবারের ঘটনার পরে ছাই পুকুরকে ঘিরে এই প্রশ্নই তুলছেন গ্রামের মানুষ। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার অমরনাথ পাল বলেন, ‘‘দুটি শিশুর মৃত্যু খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এমনিতে ছাইপুকুর সংরক্ষিত এলাকা। আগে কখনও এমন ঘটেনি। তাই বিষয়টি ভাবা হয়নি। পুকুর পর্যন্ত যাতে কেউ যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা আমরা করব।’’ কিন্তু, গত বছর এই ছাইপুকুর তৈরির পরে এত দিন তা অসুরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল কেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার মানুষজন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ গ্রামের পাঁচটি ছেলেমেয়ে ছাইপুকুরে গিয়েছিল। সব চেয়ে বড় ছিল অষ্টম শ্রেণির রাজীব। এ ছাড়া আরও তিন বালক গাব্দু, সায়ন ও চয়ন। প্রথম দু’জন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, অন্য জন পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া। দলের সবচেয়ে সদস্য রাজীবের খুড়তুতো বোন সাথী। ঢালু পাড়ে উঠে আচমকাই জলে তলিয়ে গিয়েছিল সাথী, রাজীব ও চয়ন। বাকি দু’জনের হাঁকডাক শুনে চয়নের বাবা পান্নালাল সূত্রধর গিয়ে নিজের ছেলেকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গ্রামের বেশ কিছু লোকজন। মিনিট কয়েকের মধ্যে সাথীকে জল থেকে তোলা হলেও বাঁচানো যায়নি। পুলিশ ও গ্রামবাসীদের মিলিত চেষ্টা সত্ত্বেও রাজীবকে রাতভর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুক্রবার সকাল সাতটা নাগাদ ভেসে উঠে তার দেহ।

গ্রামে দু’টি মুখোমুখি বাড়িতে বসবাস দুই ভাই কানাই ও সাধন পালের। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এক ঠিকাদারের হয়ে কাজ করা কানাইবাবুর ছোট ছেলে রাজীব। পেশায় দর্জি সাধন পালের একমাত্র মেয়ে সাথী। দাদার সঙ্গে খুব ভাব ছিল ছোট্ট সাথীর। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দু’টি স্কুলে পড়াশোনার বাইরেও দু’জন এক সঙ্গে সময় কাটাত। সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়াত। বুধবার সন্ধ্যা এক ধাক্কায় সব থামিয়ে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বৃষ্টি উপেক্ষা করে শোকস্তব্ধ পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পড়শিদের ভিড়। কিন্তু কোনও সান্ত্বনাই যে যথেষ্ট নয়। সন্তান হারিয়ে সমানে কেঁদে চলেছেন দুই মা সীমা পাল, বাবলি পালে। বাকরুদ্ধ দুই বাবাও।

দুই শিশুর মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করলেও বরাত জোরে ছেলেকে বাঁচাতে পেরে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন চয়নের বাবা, পেশায় কাঠের মিস্ত্রি পান্নালাল সূত্রধর। তাঁর স্ত্রী রমা সূত্রধর এ দিন বললেন, ‘‘আমার শ্বশুরবাড়ি খয়রাশোলের গ্রামে। কিন্তু ছেলেদের পড়াশোনার জন্য এখানেই থাকি। বুধবার দুপুরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। বিকেল বাসে নেমে বাড়ি এসেছি। ঠিক সেই সময়ই ছেলে ছাইপুকুরে ডুবেছে শুনে পড়িমরি ছুটেছিল আমার স্বামী। আর এক মিনিট দেরি হলে ছেলেটা আমার বাঁচত না!’’

এ দিনও ছাই পুকুরের ধারে পড়েছিল চয়ন, রাজীব ও সাথীর হাওয়াই চটি। পাঁচ ইউনিট বিশিষ্ট বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ছাইপুকুর ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরে, কচুজোড়ে দ্বিতীয় পুকুরের ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় ছাইপুকুর গড়া হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, জনবসতি লাগোয়া এই ছাইপুকুরটি তৈরি হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে কোনও নজর দেননি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। এমনকি ছাইপুকুরের পাশে বিশাল মাপের ম্যানহোল রয়েছে, সেগুলিও ঢাকার ব্যবস্থা হয়নি।

অন্য বিষয়গুলি:

Bakreshwar Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy