পথে বন্ধ সমর্থনকারী ও প্রতিরোধকারীদের সরগরম হাজিরা থাকলেও, মোটের উপর শান্তিপূর্ণ একটি ধর্মঘট দিবস পালন করল বীরভূম। বাম এবং বিজেপির ডাকা বন্ধ ঘিরে জেলায় বিক্ষিপ্ত কোনও ঘটনা ঘটেনি, এমন নয়। তবু, রাজ্যের অন্য জেলার নিরিখে বৃহস্পতিবার সে ছিল নিতান্তই সামান্য।
বন্ধ-বিরোধীতায় শাসক দল তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের তুলনায় উদ্যোগী ভূমিকায় ছিলেন জেলার পুলিশের একাংশ। রামপুরহাট থেকে কোটাসুর, সিউড়ি থেকে বোলপুর এবং ইলামবাজারে দেখা যায় তাঁদের বেনজির তৎপরতা। কার্যত বন্ধ বিরোধিতায় মাঠে নেমে, বুধবার বিকেল থেকেই জেলা পুলিশের একাংশকে দেখা গিয়েছে দোকান-বাজার খোলা রাখার জন্য ব্যবসাদারদের সতর্ক করতে।
জেলা সদর সিউড়িতে সরকারি স্কুল, কলেজ খোলা ছিল। উপস্থিতির হার ছিল যথেষ্ট ভাল। ওই সমস্ত দফতরের কর্মীরা ব্যক্তিগত ভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করে এসেছেন। কিছু কিছু দোকান-পাট বন্ধ ছিল। অফিস-আদালতও খোলা ছিল, উপস্থিতির হারও ছিল ভাল। এ দিন বেসরকারি বাস চলেনি। সকালের দিকে সরকারি বাসে ছিল ভিড়। এদিকে দুবরাজপুরে সকালবেলা জাতীয় সড়ক অবরোধ হয় কিছু ক্ষণের জন্য। খয়রাশোল এবং রাজনগর যেখানে সরকারি বাস চলে না, সেখানে অফিস যাত্রী এবং বিভিন্ন সেক্টরের কর্মীরা নিজেরা গাড়ি করে আসেন। অশান্তির খবর নেই ওই এলাকায়।
বন্ধ তুলতে পুলিশের ভূমিকা চোখে পড়ে রামপুরহাটে। তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বন্ধের দিন দেখা না গেলেও, পথে নেমে খোদ রামপুরহাট থানার আইসি আবু সেলিমকে দেখা যায় বন্ধ বিরোধিতায়। এ দিন রামপুরহাট স্টেশনে সিপিএমের বন্ধ সমর্থনকারীরা সকালে রামপুরহাট-বর্ধমানগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সামনে যখন ফ্ল্যাগ লাগায়, তখন রামপুরহাট থানার আইসি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গিয়ে রেল লাইন থেকে পুলিশ কর্মী দিয়ে ফ্ল্যাগ খুলিয়ে নেন। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সঞ্জিত বর্মণের অভিযোগ, ‘‘এই ভাবে পুলিশকে কোনও দিন দেখেনি ফ্ল্যাগ তুলে নিতে। আইসি শাসক দলের তাঁবেদারি করতে গিয়ে বন্ধ বিরোধিতায় পথে নেমে যা করলেন, সেটা নির্লজ্জ ঘটনা।’’
একই রকম ভাবে রামপুরহাটের পুলিশকে দেখা যায়, সকাল এগারোটা নাগাদ ওই সময়ে পুরসভার দিকে বন্ধ সমর্থনকারীদের উদ্দেশ্যে শাসানি দিতে। এ দিন সকাল এগারোটাতে পুরসভার ভিতরে থাকা খাদ্য দফতরের কর্মীরা ঢুকতে না পেরে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খাদ্য সরবরাহ দফতরের (কন্ট্রোলার)নিয়ামক সুচন্দা পাল বলেন, “দশটা থেকে কর্মীরা পুরসভার গেটের সামনে দেখেছে বাইরে তালা ঝুলছে। এবং পতাকা লাগানো। তারপর কর্মীরা ভিতরে ঢুকতে পারছে না দেখে, রামপুরহাট মহকুমাশাসককে গোটা ঘটনার কথা বলি। তিনি বিষয়টি আইসিকে দেখতে বলেন। তিনি পুলিশ বাহিনী নিয়ে আসেন। আইসির নির্দেশে পুলিশ পতাকা খুলে নেয়।”সিটু প্রভাবিত পুর কর্মচারী সংগঠনের জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, “বন্ধ সমর্থনে, একমাত্র পানীয় জল সরবরাহ কর্মচারী ছাড়া পুরসভার স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় দুই শতাধিক কর্মী বন্ধের সমর্থনে কাজে যোগ দেননি।” এমন বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া, রামপুরহাট মহকুমায় এ দিনের বন্ধ ছিল সর্বাত্মক।
এ দিন লাভপুর, নানুর, ময়ুরেশ্বর এলাকায় বনধের মিশ্র প্রভাব পড়েছে। অধিকাংশ সরকারি দফতর, স্কুল, কলেজ খোলা ছিল। কিন্তু বাস চলাচল বন্ধ থাকায় বাজার এলাকাগুলিতে, জন সমাগম অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটা কম ছিল।
ময়ুরেশ্বর এলাকায় সকাল থেকেই বিজেপি সমর্থকেরা বন্ধ সফল করতে পথে নামেন। অন্য দিকে বন্ধ বানচাল করার জন্য সক্রিয় ছিলেন এলাকার তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। এই দুইয়ের মাঝে পড়ে, চরম দোটানার মধ্যে পড়েন এলাকার ব্যাবসায়ীরা। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও, নিজেদের নিরাপত্তা এবং দোকানের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় বহু ব্যবসাদার দোকান বন্ধ করে দেন। কোটাসুরে বন্ধ সমর্থনকারী কয়েকজন সিপিএম সমর্থককে মারধর করে বলেও অভিযোগ। ওই ঘটনার ছবি তুলতে গিয়ে তৃণমূল সমর্থকদের হাতে এক চিত্র সাংবাদিক প্রহৃত হন। তাকে সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তৃণমূলের লাভপুর ব্লক সভাপতি তরুন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার লাভপুর ব্যবসায়ী সমিতির নির্ধারিত বাজার বন্ধের দিনের কারণে দোকান-পাটগুলো বন্ধ ছিল।’’
বিজেপির জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা দাবি করেন, ‘‘মানুষ এ দিনের বনধে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু শাসক দল পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে বন্ধ ব্যর্থ করার চক্রান্ত চালিয়েছে।’’ একই বক্তব্য সিপিএমের জেলা সম্পাদক রামচন্দ্র ডোমেরও। তিনি বলেন, ‘‘বন্ধ কর্মসূচী সফল করতে গিয়ে, ময়ুরেশ্বর সহ বিভিন্ন জায়াগায় আমাদের কর্মী সমর্থকেরা তৃনমূলের দুষ্কৃতী হাতে আক্রান্ত হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমও রেহাই পাইনি। পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্বেও, কোনও লাভ হয়নি।’’
বৃহস্পতিবার সাঁইথিয়ায় সাপ্তাহিকী বাজার বন্ধ। সেই অর্থে দেখতে গেলে এই বন্ধের প্রভাব তেমন ভাবে বাজারে পড়েনি। তবে যে সব দোকান পাট খোলা থাকে, এ দিন কার্যত তার অর্ধেকেরও কম দোকান খোলা ছিল। বাজারে মানুষ জনও কম ছিলেন। বেসরকারি বাস চলেনি। স্কুল, কলেজ অফিস খোলা ছিল। সাঁইথিয়া পোস্ট অফিসে বিজেপি এবং আরএমএস অফিসে বামফ্রন্ট দলীয় পতাকা লাগালে, পুলিশ গিয়ে সরিয়ে দেয়। খোলা ছিল বিএলআরও অফিসও। কিছু কিছু সরকারি বাস চলেছে সিউড়ি-বহরমপুর রুটে। মহম্মদবাজার পাথর শিল্পাঞ্চলে স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে বলাই যায়। তবে কিছু পাথর কল বন্ধ ছিল।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের খাস তালুক বোলপুরে অবশ্য এ দিন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বোলপুর জোনাল কমিটি সম্পাদক উৎপল রুদ্র বলেন, “জোর করে স্কুল কলেজ খোলা হয়েছিল। কিন্তু পড়ুয়ারা আসেনি। তবে বন্ধে সকল মানুষ সাড়া দিয়েছেন, বন্ধ সর্বাত্মক।’’
বোলপুরে বেসরকারি বাসের চাকা নড়েনি, তেমন অর্থে দোকান পাটও খোলা ছিল না। তবে, সরকারি দফতর যেমন মহকুমা শাসকের দফতর, বিডিও, বিএলএলআরও, এসডিএলআরও, এসএসডিএ-সহ একাধিক দফতরে ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ কর্মীদের হাজিরা ছিল। এ দিন বোলপুর আদালতে বিচারক, সরকারি আইনজীবি এবং প্যানেল ভুক্ত আইনজীবী-কর্মীরা উপস্থিত থাকলেও কোনও কাজ হয়নি। বোলপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্তে কোনও আইনজীবী এ দিন হাজির হননি। তবে পুলিশ ফাইল হয়েছে আদালতে।
ইলামবাজারে অবশ্য পুলিশ শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের মতো, একেবারে প্রকাশ্যে রাস্তায় নেমে বন্ধের বিরধিতা করে। বুধবার সন্ধ্যা থেকেই এলাকা এলাকায় গাড়ি নিয়ে মাইকে প্রচারের পর, এ দিন সকাল থেকে বাজার এলাকায় ঘুরে দোকান পাট খোলা রাখার আর্জি জানিয়েছে তারা। বিজেপির অন্যতম জেলা সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সিংহের অভিযোগ, ‘‘প্রশাসন রাস্তায় নেমে দোকান খোলার আবেদন রেখেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সাড়া দেওয়ায় বন্ধ সফল হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy