স্বাবলম্বী: পুরুলিয়া শহরের পথে। ছবি: সুজিত মাহাতো
স্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটোয় উঠতে গিয়ে সামনের আসনে এক যুবতীকে দেখে থমকে গেলেন যাত্রী। তাঁকে সহযাত্রী ভেবে ওই ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘ড্রাইভার কোথায়?’’ যুবতীর জবাব— ‘‘উঠে পড়ুন। আমিই চালাব। কোথায় যাবেন বলুন?’’ যাত্রীদের এমন সংশয় ভরা প্রশ্নের মুখে মাঝে মধ্যেই পড়তে হয় পুরুলিয়া শহরের এক মাত্র মহিলা টোটোচালক বছর চল্লিশের লক্ষ্মী দে-কে। কিন্তু তিনি দমে যাননি। নানা অশান্তির জন্য শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসা লক্ষ্মী এখন দুই নাবালক সন্তানকে বড় করতে টোটো নিয়ে বেরিয়েছেন।
পরনে সালোয়ার, কোমরে বাঁধা ওড়না। দিনভর যাত্রী নিয়ে শহরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে ছুটছেন তিনি। মাস চারেকের মধ্যেই এই মহিলা টোটোচালক অনেকের নজর কেড়েছেন। সম্প্রতি এক পুজো কমিটি তাঁকে দিয়ে দুর্গাপুজোর উদ্বোধনও করিয়েছে।
লক্ষ্মী আদতে ঝাড়খণ্ডের বোকারোর মেয়ে। ২০০৬ সালে বিয়ের সুবাদে তাঁর পা পড়েছিল পুরুলিয়া শহরে। কিন্তু নানা সমস্যায় সংসার টেকেনি। গত বৈশাখে স্বামীর ঘর ছেড়ে ১২ বছর ও ৯ বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে ঘরভাড়া নেন ভাটবাঁধ মোড় এলাকায়।
প্রথম দিকে, দুই বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়েছিলেন। পরে শহরের মহিলাদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তারাই লক্ষ্মীকে টোটো চালানোর প্রস্তাব দেয়। লক্ষ্মীর কথায়, ‘‘শুধু নামটুকু সই করতে পারি। তাই ছেলে দু’টোকে ভাল করে লেখাপড়া শেখাতে যে কোনও সম্মানজনক কাজ করতে রাজি ছিলাম। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে সাইকেল চালানো শিখেছিলাম। টোটোও চালাতে পারব বলে বিশ্বাস ছিল।’’
মহিলাদের ওই সংগঠন টোটোর ব্যবস্থা করে দেয়। সৈনিক স্কুলের মাঠে রোজ ভোরে এক পরিচিত ব্যক্তির কাছে টোটো চালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন লক্ষ্মী। তাঁর কথায়, ‘‘দিন পনেরো চালানোর পরে রাস্তায় নামাতে পারব বলে আত্মবিশ্বাস তৈরি হল। আর পিছনে ফিরে তাকাইনি।’’ পুরুলিয়া টাউন টোটো ইউনিয়নের সম্পাদক নেপাল পান্ডে বলেন, ‘‘আমরা সবাই লক্ষ্মীর পাশে আছি। ওঁর লড়াইকে কুর্নিস জানাই।’’
লক্ষ্মীর দিন শুরু হয় কয়েকজন পড়ুয়াকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে। তারপর বিকেল পর্যন্ত যাত্রী বহন চলে। এক ফাঁকে সেই খুদে পড়ুয়াদের ফের স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার এক ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ও অন্য জন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওরা ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে বেরিয়ে যেতে হয়। কোনও দিন তারও আগে। সকালের রান্না করারও ফুরসত পাই না। কোনও দিন ছেলে দু’টো বাইরে খেয়ে স্কুলে যায়, কোনও দিন নিজেরাই ভাত সিদ্ধ করে খেয়ে যায়। খারাপ লাগে। কিন্তু সংসার চালাতে গেলে আমার যে থামার উপায় নেই।’’
স্থানীয় কাউন্সিলর বিভাসরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘প্রতিকূলতার মুখে হার না মেনে লক্ষ্মীর লড়াইকে শ্রদ্ধা করি। এ বার আমাদের পুজোর উদ্বোধন ওঁকে দিয়েই করিয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy