বেমানান: রাসমঞ্চের পাশেই গুমটি, ত্রিপলের ছাউনি। বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আগে এ ছবি বদলের প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার। ছবি: শুভ্র মিত্র ও অভিজিৎ অধিকারী
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) হিসাবে শান্তিনিকেতন স্বীকৃতি পেতে চলেছে। এই খবরে বাংলার আর এক ঐতিহ্য-নগরী বিষ্ণুপুরের বাসিন্দারা যতটা না খুশি, তার থেকে হতাশ অনেক বেশি। তাঁদের দাবি, ইউনেস্কোর ঐতিহ্যস্থল হিসেবে ‘টেনটেটিভ’ (শর্তসাপেক্ষ) তালিকায় ২০১০ সালে নাম ওঠা শান্তিনিকেতন এ বার স্বীকৃতি পেতে চলেছে। অথচ ওই তালিকায় ১৯৯৮ সালের ৩ জুলাই থেকে বিষ্ণুপুরের মন্দির থাকলেও ২৫ বছরে বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পেল না মন্দিরনগরী। এ জন্য তাঁরা যথাযথ উদ্যোগের অভাবকেই দায়ী করছেন।
এশিয়ার প্রাচীনতম সঙ্গীত কলেজ বিষ্ণুপুরের রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সুজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বিষ্ণুপুরের মন্দিরের গঠন-সৌন্দর্য, মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্য, টেরাকোটার নকশায় পৌরাণিক কাহিনির বিবরণ— সব মিলিয়ে যা আছে তা ঐতিহ্যের দিশারী হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট। তবুও কেন বিষ্ণুপুর বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পাওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। অবশেষে শান্তিনিকেতন সে স্বীকৃতি পেতে চলায় আমরা খুশি, কিন্তু বিষ্ণুপুরের নাম না থাকায় অনেক বেশি হতাশ।’’
বিষ্ণুপুর তথা বাঁকুড়া জেলার ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে সাজানো আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবনের কিউরেটর তুষার সরকার বলেন, “বিষ্ণুপুরের শুধুমাত্র স্থাপত্য, টেরাকোটার মন্দিরই নয়, এখানকার বহু ঐতিহ্যবাহী শিল্প দশাবতার তাস, বালুচরি শাড়ি, পোড়ামাটির শিল্প, শঙ্খ ও লন্ঠনও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান বিষ্ণুপুরে রয়েছে। ২৫ বছর আগে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও কোন অজ্ঞাতকারণে তা বাস্তাবায়িত হল না, ভেবে পাচ্ছি না।’’
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বৈষ্ণব ধর্মে দিক্ষিত মল্লরাজ বীর হাম্বির মাকড়া পাথরের টেরোকোটার রাসমঞ্চ তৈরি করেছিলেন ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে। ১৬৪৩ সালে শ্যামরাই মন্দির গড়েন রঘুনাথ সিংহ, ১৬৫৫ সালে তিনিই গড়েন জোড়বাংলা। এমনই বহু মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে বিষ্ণুপুর শহর ও আশপাশে। তার মধ্যে বেশ কিছু মন্দির ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সংরক্ষিত।
এক সময়ে জঙ্গল কেটে মল্লরাজাদের গড়ে তোলা রাজধানী বিষ্ণুপুর এখন কার্যত ইট-কাঠের জঙ্গলে ঘেরা হয়ে গিয়েছে। শহরের মধ্যে বেশ কিছু মন্দিরের আশপাশে বহুতল তৈরি হয়েছে। কিছু মন্দিরের বেড়ার গায়ে জামা-কাপড় শুকোতে দেওয়া দেখে ব্যথিত হন পর্যটকেরা। শহরের রাস্তাঘাটও ঘিঞ্জি। দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা বেড়াতে এসে এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করেন।
সূত্রের খবর, বেশ কয়েক মাস আগে ইজরায়েল থেকে বিষ্ণুপুর পরিদর্শনে আসা ইউনেস্কোর এক প্রতিনিধি এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধিগৃহীত মন্দিরগুলির ইতিহাস তুলে ধরা ও সংরক্ষণ নিয়ে তিনি খুশি হলেও শহরের সামগ্রিক পরিকাঠামো নিয়ে তিনি খুশি হতে পারেননি। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ সব বিষয় বিষ্ণুপুরের বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তকমা পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় কি না, তা নিয়ে চর্চা চলছে বিভিন্ন মহলে।
বিষ্ণুপুরের মহকুমারশাসক অনুপকুমার দত্ত বলেন, ‘‘দফায় দফায় পরিকল্পনা করে বিষ্ণুপুরের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা হচ্ছে। তবে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের স্বীকৃতি পেলে কাজে আরও উৎসাহ পাওয়া যেত।’’
বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁয়ের দাবি, ‘‘যতদূর জানি, বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের স্বীকৃতি পেতে গেলে আগে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যকে নাম সুপারিশ করতে হয়। তবে বিষ্ণুপুরের মন্দির যাতে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের স্বীকৃতি পায়, সে জন্য আমি দিল্লিতে কথাবার্তা বলব।’’ তৃণমূলের বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি অলক মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘সাংসদ বিষ্ণুপুরের জন্য কিছুই করেননি। কেন্দ্রও এ রাজ্যের ভাল কিছু চায় না, তাই বিষ্ণুপুর নিয়ে উদ্যোগী হয়নি।’’ তবে বিষ্ণুপুরের কলেজ ছাত্র রূপম মালের মতো অনেকেই আশাবাদী। তাঁরা বলছেন, ‘‘বিশ্বের দরবারে বিষ্ণুপুর এমনিতেই প্রতিষ্ঠিত। এক দিন ঠিকই বিষ্ণুপুরের মন্দির বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের স্বীকৃতি আদায় করে ছাড়বে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy