এখানেই: জামিরা টিলার এই গর্তেই চাপা দেওয়া ছিল মণিকা মাহাতোর দেহ। ছবি: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো, ইনসেটে মণিকা
মাঝের সাত দিন
সময় হয়ে গেলেও ফিরছে না মেয়ে। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। মণিকার বাবা সমীরকুমার মাহাতোর দাবি, ৩ মে বিকেলেই তাঁরা থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। মৌখিক ভাবে। তার পরেও বারে বারে গিয়েছেন থানায়। কিন্তু অভিযোগ নিতে গড়িমসি করেছে পুলিশ। তাঁদের প্রশ্ন, একটা জ্বলজ্যান্ত মেয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলেও কেন পুলিশ গা করছিল না? তা হলে কি কিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছিল?
কে মণিকা? মণিকা মাহাতো। সতেরো বছর বয়স। বাড়ি বোরোর বড় মামরো গ্রামে। মাধ্যমিকের পরে বান্দোয়ানের এ এন ঝা হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল। জেঠুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত।
পুলিশ মানছে না। দাবি করে আসছে, ৬ মে মামলা দায়ের হয় বান্দোয়ান থানায়। লিখিত অভিযোগপত্রে দুই যুবকের নামও উল্লেখ করেন মণিকার বাবা। সেই অরুণ মাহাতো ও অরিজিৎ মাহাতোকে ৯ মে গ্রেফতার করা হয়। অরুণ বান্দোয়ান মহাবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অরিজিৎ আঁকরোর একটি দোকানের কর্মচারী। দু’জনেই থাকে হাতিরামগোড়া গ্রামে।
১০ মে উদ্ধার হয় মণিকার দেহ।
কী ঘটেছিল সেই দিন? ৩ মে। সবার মুখে তখন ফণীর কথা। সেই ঘূর্ণিঝড়। কোন পথে আসবে, কোথায় পড়বে আছড়ে, ক্রমশ বাড়ছে চিন্তা। আর সেই চিন্তায় রাজ্যের সমস্ত স্কুলে সাত তাড়াতাড়ি গরমের ছুটি পড়ে গেল ওই দিন থেকেই। সকালে বান্দোয়ানে জেঠুর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল মণিকা। কথা ছিল, টিউশন সেরে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু সেই যে বেরিয়েছিল মেয়েটি, সপ্তাহ পার করে খোঁজ মিলল তার। দূরের টিলার উপর থেকে উদ্ধার হল পচাগলা দেহ।
পুলিশের দাবি, অরুণ খুনের কথা স্বীকার করেছে। দাবি করেছে, অরিজিৎকে নিয়ে তার ও মণিকার মধ্যে টানাপড়েন চলছিল। ওই দিন সে মণিকার সঙ্গে বান্দোয়ান বাসস্ট্যান্ডে দেখা করে। তাকে মোটরবাইকে চাপিয়ে নিয়ে যায় বোরোর জামিরা টিলায়। অরিজিৎ এবং অরুণের বাড়ি টিলা থেকে মেরেকেটে আড়াই কিলোমিটার দূরে। কথা কাটাকাটির মধ্যে মণিকার মোবাইলে অরিজিতের ফোন আসে বলে দাবি অরুণের। কথাও হয়। অরুণ ফোনটা কেড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় টিলা থেকে। পুলিশ জানাচ্ছে, অরুণ দাবি করেছে, এর পরেই সে গলা চেপে ধরে মণিকার। মৃত্যুর পরে দেহ পাথর চাপা দিয়ে ফিরে আসে।
প্রশ্নের কাঁটা
গাড়ি। মোবাইল। গাঁইতি।
এই তিনটে ব্যাপারের মধ্যে অনেক রহস্য জমাট বেধে আছে বলে দাবি করছে ছাত্রী-খুনের বিচার চেয়ে সরব হওয়া বিভিন্ন সংগঠন। মণিকার পরিবারও অভিযোগ করছে, রাগের মাথায় ওই তরুণীকে খুন করা হয়নি। রীতিমতো পরিকল্পনা করে অপহরণ করা হয়েছিল। তার পরে খুন করে দেহ ফেলে যাওয়া হয়েছে টিলার উপরে।
গাড়ি
কী থেকে মনে হচ্ছে এমনটা? পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগপত্রে মণিকার বাবা লিখেছেন, মেয়েকে বান্দোয়ান বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। বান্দোয়ান থেকে জামিরা যাওয়ার পথে চিলা গ্রামের আগে একটি কালভার্ট পড়ে। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ওই দিন কালভার্টের ধারে আড্ডা দিচ্ছিলেন দু’জন। বেলা তখন সাড়ে ১০টা। তাঁরা দাবি করেছেন, হঠাৎ দেখেন ছাতা মাথায় একটি মেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। পিঠে স্কুলব্যাগ। কালভার্টের উপরে দাঁড়িয়েছিল একটি গাড়ি। মেয়েটি কাছাকাছি আসতেই গাড়ির পিছনের দরজা খুলে গেল। কিন্তু, বাইরে থেকে ঠেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে এগিয়ে গেল মেয়েটি। চোখের পলকে দেখেন গাড়ি চলছে। ভিতরে মেয়েটি। কখন, কী ভাবে সে ভিতরে গেল, বুঝতে পারেননি বলে দাবি করেছেন তাঁরা। জানিয়েছেন, সন্দেহ হওয়ায় স্কুটার নিয়ে পিছু ধাওয়া করেছিলেন। কিন্তু নাগাল পাননি। চিলা গ্রামের কাছে বাঁক নিয়ে বান্দোয়ানের দিকে বেরিয়ে যায় গাড়িটি। প্রশ্ন উঠছে, ওই মেয়েটিই কি মণিকা? ওই গাড়িতেই কি অপহরণ করা হয়েছিল তাকে? পুলিশ দাবি করছে, তদন্তে নেমে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেও কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। অরুণ গ্রামেরই এক জনের বাইক নিয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেছে। সেটি উদ্ধার করা হয়েছে।
মোবাইল
মণিকার সঙ্গে ছিল ফোন। যেটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। যতক্ষণ ফোন চালু ছিল, টাওয়ারের সঙ্গে তার যোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। কোন নম্বর থেকে ফোন আসছে, কোন নম্বরে ফোন যাচ্ছে, কতক্ষণ কথা হচ্ছে— এই সমস্ত হিসেব-নিকেশ যেমন মোবাইলে থাকে, তেমনই টাওয়ারেও থাকে। পুলিশের দাবি, ওই সময়ে মণিকা এবং অরুণের ফোনে জামিরা টিলার কাছের একটি টাওয়ার থেকে নেটওয়ার্ক ধরছিল। সেখান থেকেই জানা যাচ্ছে, মণিকার ফোনে অরিজিতের নম্বর থেকে ফোন এসেছিল। কথাও হয় কিছুক্ষণ। কিন্তু পরিবারের প্রশ্ন, ফোনটা কেন উদ্ধার করতে পারল না পুলিশ?
টিলার ঢাল খাড়া নয়। ঢালু একটা রাস্তা নেমে গিয়েছে। ফলে উপর থেকে যদি ফোনটা ছুড়েও দেওয়া হয়, হাতের জোরে খুব দূরে সেটির গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা অল্পই থাকে। পুলিশ বলছে, বিস্তর খোঁজা হয়েছে। ঘটনার পুনর্নির্মাণের সময়ে অরুণ একটি জায়গা দেখিয়ে দাবি করেছিল, সেখান থেকে সে ফোন ছুড়ে ফেলেছে। প্রথমে পুলিশ আধিকারিক এবং সিভিক ভলান্টিয়ার মিলিয়ে দশ জন সেটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন। পরে তিরিশ জনের একটি দল গিয়ে আঁতিপাতি করে খোঁজে। কিন্তু মোবাইল আর পাওয়া যায়নি। সেটা গেল কোথায়, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
গাঁইতি
পুরুলিয়ার শক্ত মাটিতে একটা দেহ পুঁতে ফেলা সহজ কাজ নয়। প্রশ্ন উঠছে, অরুণ সেটা করল কী করে? মণিকার পরিবার এবং কিছু সংগঠনের বক্তব্য, তাহলে কি সে মাটি খোঁড়ার জন্য গাঁইতি, শাবল বা অন্য কিছু নিয়ে গিয়েছিল? অরুণ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার নামে পুলিশের কাছে এর আগে কখনও কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। রাগের বশে সে খুন করে কোনও আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই একটা গর্তে দেহ, অন্য গর্তে ব্যাগ পুঁতে ফেলল— এই তত্ত্ব মানতে চাইছেন না মণিকার পরিজনেরা।
তবে পুলিশ দাবি করছে, গর্ত আগেই ছিল। ওই টিলা থেকে অনেকে মাটি কেটে নিয়ে যান। পাথুরে মাটি। অনেক কাজে লাগে। ঘরের সামনে ফেলে দিলে শুকনো থাকে। পুলিশের একটি সূত্র দাবি করছে, যে গর্ত থেকে মণিকার দেহ মিলেছিল, সেটির ভিতরে গাছপালা গজিয়ে রয়েছে। সেটা রাতারাতি সম্ভব নয়। তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, গর্তে দেহ ফেলে টুকরো পাথরে চাপা দিয়েছিল অরুণ। ফলে দেহ পচার পরেই গন্ধ বেরোতে শুরু করে। কেন্দুপাতা আনতে গিয়ে সেই গন্ধই পান কিছু লোকজন।
আগে কি নির্যাতন?
বৃহস্পতিবার সকালে ‘আমরা আক্রান্ত’ নামে একটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা বোরোতে গিয়ে মণিকার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। ঘটনাস্থলেও যান। ওই সংগঠনের তরফে অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘পরিবারের লোকজনের ধারণা, মণিকাকে খুনের আগে নির্যাতন করা হয়ে থাকতে পারে। তদন্তে সেই অভিযোগে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।’’ একই দাবি করছে বিচার চেয়ে সরব বিভিন্ন সংগঠন।
তবে পুলিশের দাবি, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নির্যাতনের কোনও উল্লেখ নেই। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিকদের কেউ কেউ আবার বলছেন, পচাগলা দেহের ময়না-তদন্তে অনেক সময়ে নির্যাতনের প্রমাণ ধরা পড়ে না। সে ক্ষেত্রে ফরেন্সিক পরীক্ষা করাতে হয়। মণিকার বেলায় কি তা হয়েছিল? পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, হয়নি। তবে ওই সূত্রই বলছে, ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সিআইডি এখন ঘটনার তদন্ত করছে।
ফলে, পরীক্ষা করার সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি।
মণিকা-খুনের বিচার চেয়ে পুরুলিয়া থেকে হেঁটে কলকাতা পাড়ি দিয়েছেন নাট্যকর্মী তিন যুবক। আগামী ৯ জুন কলকাতায় প্রতিবাদে সরব হবেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা। আর জেলার বাতাসে উত্তরের খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছে এই সমস্ত প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy