ছবি: সংগৃহীত
শহরে জলসঙ্কটের স্থায়ী সমাধানে নিজেরাই একটি জলপ্রকল্প গড়তে উদ্যোগী হয়েছিল পুরসভা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে সেই প্রকল্প গড়ার আর্থিক অনুমোদন দিল পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর। এই মর্মে চিঠিও পৌঁছে গিয়েছে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর পুরসভায়। পুরভোটের আগে ওই জলপ্রকল্পকে সরকার ছাড়পত্র দেওয়ার নেপথ্যে ‘রাজনীতি’ রয়েছে বলে দাবি বিরোধীদের। তাদের অভিযোগ, পুরবোর্ড তৃণমূলের হাতে রয়েছে বলেই নির্বাচনের আগে প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
রঘুনাথপুরে জল সরবরাহ নিয়ে শহরবাসীর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পুরসভার তেরোটি ওয়ার্ডেই পর্যাপ্ত জল পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের। বিশেষ করে উঁচু এলাকায় ওয়ার্ডগুলিতে জল কার্যত পাওয়াই যায় না। রয়েছে ‘জলচুরি’র সমস্যাও। ফলে, যাঁরা বৈধ সংযোগ নিয়েছেন, তাঁরা পর্যাপ্ত জল পান না বলে অভিযোগ। পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাজারপাড়া এলাকার বাসিন্দা অজিত চন্দ্রর অভিযোগ, ‘‘জল চুরির ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। যার ফলে আমাদের মতো বাসিন্দারা, যাঁরা বৈধ ভাবে জলের সংযোগ নিয়েছেন, তাঁরা জল প্রায় পাচ্ছেন না। পুরসভা এই বিষয়ে উদাসীন।”
পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মালিগলিপাড়ার বাসিন্দা সুপ্রিয় রায়ের বক্তব্য, ‘‘ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্প থেকে জল আসে না। এখনও পানীয় জলের জন্য ভরসা করতে হয় টিউবওয়েলের উপরে।” পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তাঁতিপাড়ার বাসিন্দা অভ্র রায়চৌধুরীর আবার অভিযোগ, ‘‘শহরের উঁচু এলাকায় জল এক প্রকার পাওয়াই যায় না। যত সংখ্যক বাড়িতে জলের সংযোগ দেওয়া যায়, তার থেকে বেশি বাড়িতে সংযোগ দিয়ে পুরসভা নিজেই জলসঙ্কট তৈরি করেছে।” ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা উওম রায় এবং ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গোপী আচার্য বলেন, ‘‘আগে সকালে ও বিকালে দু’ঘণ্টা করে জল সরবরাহ করা হত। এখন সেই সময় কমেছে। শীতকালে জলের সমস্যা কিছুটা কম থাকে। গরম শুরু হতেই জলসঙ্কট বাড়ে।’’ তাঁদের অভিযোগ, ‘‘বছরে টানা আট-ন’মাস দিনে দু’বেলা খুব বেশি হলে মিনিট কুড়ি জল সরবরাহ করা হয়।’’
জলসঙ্কট মেটাতে পুরসভার ‘ব্যর্থতা’কে এ বারের পুরভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে বলে কোমর বেঁধেছেন বিরোধীরা। ঠিক এই সময় পুরসভার জলপ্রকল্পকে রাজ্য সরকার আর্থিক অনুমোদন দেওয়ায় তৃণমূল ভোটের আগে অক্সিজেন পাবে বলে মনে করছেন শহরের রাজনীতির ওঠাপড়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের একাংশ। বিজেপির শহর সভাপতি স্বপ্নেশ দাসের কথায়, ‘‘দিনে এক-দু’ বালতির বেশি জল পাওয়া যায় না। তৃণমূল জল সরবরাহে ব্যর্থ। এখন নতুন করে জলপ্রকল্প গড়ার গল্প শুনিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন ওঁরা।”
পুরসভার সিপিএম কাউন্সিলর তথা পুরসভার বিরোধী দলনেতা প্রদীপ দাসের মন্তব্য, ‘‘গত দেড় দশক ধরে পুরসভায় ক্ষমতায় তৃণমূল। কিন্তু জল সমস্যার স্থায়ী সমাধান করে উঠতে পারেনি তারা। মানুষ এর জবাব চাইছে।” বিরোধীদের এই বক্তব্যকে নস্যাৎ করে রঘুনাথপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা তৃণমূল নেতা ভবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘বিরোধীরা যে কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্পেই বাগড়া দেন। ওঁরা ওঁদের কাজ করুন। আমরা উন্নয়ন করব। রাজ্যের কাছে তদ্বির করে অর্থ বরাদ্দ করাতে পেরেছি।”
এখন নিতুড়িয়ার লক্ষ্মণপুরের ইন্দো-জার্মান জলপ্রকল্প থেকে রঘুনাথপুরে জল সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর। সূত্রের খবর, গত কয়েক বছর ধরে ওই প্রকল্প থেকে গ্রামাঞ্চলেও জল যাচ্ছে। সে কারণে শহরে জলের সরবরাহে টান পড়েছে। পুরসভা সূত্রের দাবি, চুক্তি মোতাবেক রঘুনাথপুরে দৈনিক ২১ লক্ষ লিটার জল সরবরাহ করার কথা জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের। কিন্তু বাস্তবে দেওয়া হয় অর্ধেকেরও কম জল। গ্রীষ্মে তা আরও কমে।
বছরখানেক আগে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি জলপ্রকল্প গড়েছিল পুরসভা। কিন্তু ভূগর্ভ থেকে পর্যাপ্ত জল মেলেনি। পরে রঘুনাথপুর ২ ব্লকের দামোদরের করগালি ঘাট থেকে জল নিয়ে রঘুনাথপুরে জল সরবরাহ করতে আরও একটি প্রকল্প তৈরিতে উদ্যোগী হয় পুরসভা। এই প্রকল্পে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপ লাইন পাততে হবে। তৈরি করতে হবে কয়েকটি ‘ওভারহেড রিজ়ার্ভার’ ও জল পরিশোধন কেন্দ্র। প্রকল্প গড়তে শহরের প্রান্তে বাবুগ্রাম পঞ্চায়েতের সিলেটি মৌজায় জমিও পেয়েছে পুরসভা। কিন্তু পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের আর্থিক অনুমোদন না মেলায় প্রকল্পের কাজ থমকে ছিল। সরকারি অনুমোদন মিলায় এখন আর প্রকল্প রূপায়ণে কোনও সমস্যা নেই।
পুরসভা সূত্রের খবর, প্রকল্প গড়ার জন্য কমবেশি ৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দৈনিক ১ কোটি ৩৫ লক্ষ লিটার জল রঘুনাথপুর শহরে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। শহরে জলের চাহিদা দৈনিক ৬০ লক্ষ লিটারের মতো। বাড়তি জল রঘুনাথপুর মহকুমার শিল্পাঞ্চল এলাকায় বিক্রি করার পরিকল্পনা রয়েছে পুরসভার। রঘুনাথপুরের পু্রপ্রধান তৃণমূলের মদন বরাট বলেন, ‘‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে জলপ্রকল্পের আর্থিক অনুমোদন পাওয়া গিয়েছে। দ্রুত দরপত্র আহ্বান করে প্রকল্প গড়ার কাজ শুরু করব।” নতুন প্রকল্প গড়তে কমপক্ষে আট-দশ মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছে পুরসভা। ফলে, এ বার গরমে শহরের জলসঙ্কট থেকে মুক্তি মিলবে না, এমনই আশঙ্কা অনেক এলাকাবাসীরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy