প্রতীকী ছবি।
দৃশ্য এক, কী ভাবে সে অন্যদের সঙ্গে ক্লাস করবে এই প্রশ্ন তুলে নলহাটি ২ ব্লকের এক দৃষ্টিহীন ছাত্রীকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি নিচ্ছিল না এলাকার এক কো-এড স্কুল। সিউড়ির একটি সরকারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়লেও মূক-বধির আর এক ছাত্রী তো স্কুলের পড়া বুঝতেই পারছিল না। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত দুবরাজপুরের অন্য আর এক শিশুর ভবিষ্যত কী হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন পরিজনেরা।
দৃশ্য দুই, নলহাটি ২ ব্লকের সেই দৃষ্টিহীন ছাত্রী পরের বার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। সিউড়ির মূক ও বধির ওই ছাত্রী বর্তমানে কোনও সমস্যা ছাড়াই ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত দুবরাজপুরের শিশু বর্তমানে শুধু দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র নয়, ইউনিফায়েড ফুটবলে জেলা দলের সদস্যও বটে। যাঁদের হাত ধরে এই উত্তরণ, তাঁরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন পড়ুয়াদের সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার উপযুক্ত করে তোলার দায়িত্বে থাকা স্পেশ্যাল এডুকেটর।
দৃষ্টিহীন ওই ছাত্রীকে নিয়ে গিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করানো, শ্রবণযন্ত্র ও স্পিচ থেরাপির সাহায্য সিউড়ির মূক ও বধির ছাত্রীকে কথা বলতে শেখানো এবং সাইকো ও ফিজিওথেরাপি দিয়ে দুবরাজপুরের সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত ছেলেটিকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসার কৃতিত্ব ওই স্পেশ্যাল এডুকেটরদেরই। এ কথা ঠিক যে, শুধু ওই তিন জন নয়। জেলা জুড়ে এমন অনেক পড়ুয়াকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জেলার ‘নিকুম্ভ স্যররা’। তবে এটাই সামগ্রিক ছবি নয়। সত্যিটা হল, নানা সমস্যায় জেরবার স্পেশ্যাল এডুকেটররা জেলার অধিকাংশ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর কাছে পৌঁছতেই পারছেন না।
আলাদা স্কুলে নয়, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা আর পাঁচটা শিশুর মতো সাধারণ স্কুলেই পড়বে। শিক্ষার অধিকার আইন ও সমন্বিত শিক্ষার সরকারি ভাবনা ফলপ্রসূ করতেই চুক্তিভিত্তিক স্পেশ্যাল এডুকেটরদের নিয়োগ। কিন্তু, ইচ্ছে থাকলেও নানা সমস্যায় যথাযথ পরিষেবা তাঁরা দিতে পারছেন না, সে কথা মেনে নিচ্ছেন জেলা ও জেলার বাইরে থাকা স্পেশ্যাল এডুকেটররা।
সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
একাধিক সমস্যার কথা জানিয়েছেন এ কাজে নিযুক্ত স্পেশ্যাল এডুকেটররা। মূল সমস্যা তিনটি— এক, সীমিত সংখ্যা, দুই, দুর্বল বেতন কাঠামো, তিন, বাড়ি থেকে বহু দূরে পোস্টিং হওয়া। তাঁদের অনেকেই জানাচ্ছেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য প্রতি চক্রে মানসিক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য অন্তত তিন জন স্পেশ্যাল এডুকেটর থাকা প্রয়োজন। সেখানে ৩২টি চক্রে মাত্র ৬২ জন স্পেশ্যাল এডুকেটর রয়েছেন। যাঁদের উপরে নির্ভর করছে জেলার ৬ হাজারেরও বেশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়া।
স্পেশ্যাল এডুকেটরদের দাবি, দৃষ্টিশক্তিহীনদের ব্রেইল পদ্ধতি শেখানো, মূক ও বধিরদের জন্য স্পিচ থেরাপি, মানসিক বিকাশে পিছিয়ে থাকাদের জন্য সাইকো ও ফিজিওথেরাপি এবং অর্থোপেডিক সমস্যার জন্য ফিজিওথেরাপি প্রয়োজন। তাঁদের সংযোজন, ‘‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়াদের স্কুলে স্কুলে এবং বাড়িতে ভিজিট করার কথা। বিশেষ করে মানসিক বিকাশে পিছিয়ে থাকা পড়ুয়াদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হয়। সেখানে এক একজন স্পেশ্যাল এডুকেটর কমবেশি ১০০টি স্কুলের দায়িত্বে রয়েছেন।’’ প্রশ্নও সেখানেই। এত সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিজিট করা, তাদের বাড়ি যাওয়া, সার্কেল লেবেল রিসোর্স সেন্টারে নিয়ে এসে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সাধারণ স্কুলের শিক্ষক ও পড়ুয়ার বাবা-মাকে এ ব্যাপারে সচেতন করা, কী ভাবে করা সম্ভব।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল বেতন কাঠামো ও বাড়ি থেকে দূরে পোস্টিং হওয়া। প্রতি মাসে একজন স্পেশ্যাল এডুকেটরের জন্য বরাদ্দ ১২,৫০০ টাকা। কেটেকুটে হাতে আসে মাত্র ১০ হাজার ৮৯০ টাকা। এই অবস্থাতেও কোচবিহার থেকে কেউ কাজ করছেন বীরভূমে, আবার কারও বাড়ি বীরভূমে তিনি কাজ করছেন পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়ে। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেউ পোস্টিং রয়েছেন পশ্চিম বর্ধমানের চিত্তরঞ্জন সার্কলে। ‘‘বাড়িভাড়া করে এবং সংসার খরচ চালিয়ে কাজটা আন্তরিকতার সঙ্গে করা সম্ভব নয়’’, অনুযোগ স্পেশ্যাল এডুকেটরদের।
সর্বশিক্ষার এক কর্তার দাবি, ‘‘বেতন কাঠামো দুর্বল, বাড়ি থেকে দূরে পোস্টিং হওয়ার বিষয়টি ঠিকই। কিন্তু, কাজের চাপের কথা বলা হচ্ছে সেটা কিন্তু ওঁদের নেই।’’ ওই কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘এক একজনকে ১০০টি স্কুলের দায়িত্ব নিতে হয়, সেটা ঠিক নয়। একটি চক্রে দু’জন থাকলেই তো সংখ্যা বিভক্ত হয়ে যায়। যে সব পড়ুয়াকে সাহায্য করার প্রয়োজন, সেই পড়ুয়া ও স্কুলের সংখ্যাও তো হাতেগোনা। এখানে আন্তরিকতার বিষয়ই বড়।’’ তবে সমস্যা আরও রয়েছে। অভিযোগ, স্পেশ্যাল এডুকেটরদের স্কুল পরিদর্শকদের অফিসে বসিয়ে কার্যত অফিসের কাজ করানো হয়। বাইরে বের হলে সীমিত পয়সা থেকে আরও খরচ হয়, এই ভয়ে অনেকে স্কুল পরিদর্শকের অফিসে সময় কাটানোই শ্রেয় মনে করেন।
এ কথা মানছেন স্পেশ্যাল এডুকেটরদের একাংশও। সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি, তাতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সমন্বিত শিক্ষায় আওতায় আনার উদ্দেশ্যই টোল খাচ্ছে বলে দাবি সব মহলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy