অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল ছবি।
গরু পাচারকাণ্ডে সিবিআইয়ের করা মামলায় সুপ্রিম কোর্টে জামিন পেয়েছেন তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। সেই খবর বীরভূমে এসে পৌঁছতেই খুশির হাওয়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের মধ্যে। প্রায় দু’বছর বীরভূম অনুব্রতহীন। বোলপুর শহরের নিচুপট্টি এলাকার নীল রঙা বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। একটা সময় এই বাড়িতে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা তো বটেই সাধারণ মানুষের ভিড়ে গমগম করত। কিন্তু ২০২২ সালের ১১ অগস্ট বাড়ি থেকে অনুব্রতকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তার পর থেকেই এলাকা জুড়ে একটা থমথমে ভাব ছিল। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের খবর পাওয়া মাত্রই সেই থমথমে ভাব কিছুটা হলেও উধাও। তাঁর বাড়ির উল্টো দিকের চায়ের দোকানের মালিক থেকে শুরু করে তৃণমূল কর্মীরা আনন্দে মেতেছেন। জেলার তৃণমূল নেতৃত্ব আশাবাদী, ‘‘খুব তাড়াতাড়ি জেলার অভিভাবক ফিরে আসবেন।’’
অনুব্রত বীরভূমে তৃণমূল জেলা সভাপতি থাকাকালীন কাজল শেখের সঙ্গে বিবাদ সুবিদিত ছিল। দু’পক্ষের অন্তর্বিরোধও বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। তবে প্রকাশ্যে সব সময়ই দু’জনকে হাসিমুখে দেখা গিয়েছে। গরু পাচার মামলায় অনুব্রত জেলে যাওয়ার পরে দলে কাজলের গুরুত্ব বাড়ে। জেলা সভাপতি পদ শূন্য রেখেই তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা কোর কমিটি গড়ে দেন। সেই কমিটির সদস্য তথা বীরভূম জেলা সভাধিপতি কাজলও ‘কেষ্টদা’র জামিনের খবরে খুশি। অনুব্রতের গ্রেফতারি এবং জেলবন্দি থাকাকে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ হিসাবেই দেখছেন কাজল।
তিনি বলেন, ‘‘আমরা বার বার বলেছি, আমাদের জেলার অভিভাবক অনুব্রত মণ্ডলকে মিথ্যা মামলায় তিহাড় জেলে আটকে রাখা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। সেটাই প্রমাণিত হল। সিবিআইয়ের মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। আগামী দিনে ইডির মামলাতেই তিনি জামিন পেয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন।’’ কাজল আশাবাদী, ‘‘২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অনুব্রত স্বয়ং জেলায় থেকে অভিভাবকের আসনে বসে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। তিনি আমাদের জেলা সভাপতি ছিলেন আছেন, আগামী দিনেও থাকবেন।’’
বীরভূমে তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা গেল খুশির বার্তা। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা জেলা তো বটেই, বাংলার মানুষও প্রত্যাশা করেছিলেন। সেই প্রত্যাশা কিছুটা পূরণ হল আদালতের রায়ে। অনুব্রতকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাঁর জামিনে আমরা সকলে খুশি। খুব শীঘ্রই ইডির মামলাতেও জামিন পেয়ে কেষ্ট দা জেলায় ফিরবেন।’’ অনুব্রতের দাদা আশাবাদী, ‘‘এই অগস্টেই জেলা ফিরে আসবে ভাই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘শুধু যে অপেক্ষায় আছি তা নয়, আমরা চাইছি অগস্টেই ফিরুক। দু’বছর ধরে মানসিক ভাবে আমরা বিধ্বস্ত ছিলাম। আজ খুশি।’’
নিচুপট্টি এলাকার নীল রঙা বাড়িটার উল্টো দিকে একটা ছোট্ট দোকান। সেই দোকানে চা বানাতে ব্যস্ত হারাধন চক্রবর্তী। তাঁর চোখেমুখে খুশির আভাস। অনেক দিন ধরেই ওই এলাকার বাসিন্দা এবং ব্যবসা করার সুবাদে অনুব্রতের পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ‘কেষ্টদা’কে সিবিআই ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরে অন্যান্যদের মতো তিনিও দুঃখ পেয়েছিলেন। মঙ্গলবার জামিনের খবরে খুশি হারাধন বলেন, ‘‘আমরা চাইছিলাম কেষ্টদা বেরিয়ে আসুক। তিনি জামিন পাওয়াতে আমার মতো পাড়ার লোক সকলেই খুশি। সামনের বাড়িটা ফাঁকা পড়ে থাকত। আমাদের পাশে থাকা লোক জেলে আছে জেনে খারাপ লাগত।’’
বীরভূমে তৃণমূলের শেষ কথা অনুব্রত গরু পাচার মামলায় গ্রেফতার হয়ে তিহাড় জেলে বন্দি। অনুব্রতের কন্যা সুকন্যাও তিহাড়েই। স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ফলে বোলপুরের নিচুপট্টিতে কেষ্টর বাড়ি থাকে তালাবন্ধই। একদিন যে বাড়ির সামনে লাইন পড়ত সাধারণ মানুষের, আজ সেই বাড়ির সামনেটা পুরোপুরি সুনসান। তবে মঙ্গলবার সেই ছবি কিছুটা পাল্টাল। অনেক তৃণমূল কর্মী-সমর্থক, অনুগামীরা আসছেন ‘দাদা’র বাড়ির সামনে।
কেষ্টর জামিনে তৃণমূলে খুশির হাওয়া থাকলে জেলা বিজেপি মনে করছে ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। বিজেপি জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহা বলেন, ‘‘যাঁরা লাফালাফি, নাচানাচি করছেন, তাঁদের তা না করাই ভাল। গরু পাচার মামলার তদন্ত চলছে। যাঁরা চুরি করেছেন, তাঁদের শাস্তি পেতেই হবে। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আইন আইনের পথে চলবে। আমরা আইনের উপর আস্থাশীল। বিচার ব্যবস্থার উপর ভরসা রাখি।’’ একই সুর শোনা গেল বীরভূমের জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক শান্তনু মণ্ডলের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘অনুব্রতের বিরুদ্ধে অনেকগুলি মামলা চলছে। তার মধ্যে একটা গরু পাচার। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছে জামিন দেওয়া প্রয়োজন, তাই জামিন দিয়েছে। কিন্তু আমরা সাধারণ নাগরিক হিসাবে এটুকুই চাইব, সিবিআই বা ইডি খুব তাড়াতাড়ি যেন ব্যবস্থা নেয়, যাতে তাঁর সাজা হয়। উনি এত দুর্নীতি করেছেন, এত বেনামি সম্পত্তি করেছেন, এত মানুষের উপর অত্যাচার করেছেন, তাতে তাঁর জেল থেকে বার হওয়াই উচিত নয়। আগামী দিনে আশা করব, উনি জেল থেকে বার হবেন না, সারা জীবন জেলেই থাকবেন।’’
বীরভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি মিল্টন রশিদ বলেন, ‘‘গরু পাচার মামলায় আসল কী ঘটনা, তা ইডি-সিবিআই জানে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তা নিয়ে বলার কিছু নেই। আদালতের মনে হয়েছে জামিন পাওয়ার তাই দিয়েছে। জামিন পেয়েছে মানে এই নয় তিনি মুক্তি পেয়েছেন। একটা মামলায় এখনও জামিন পাননি। আদালত যদি মনে করে সেই মামলায় জামিন দেবে, তবে তিনি বাড়ি আসবেন।’’ সিপিএম আবার এই ঘটনায় ‘তৃণমূল-বিজেপির আঁতাঁত’ দেখছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘একটা লোককে কত দিন জেলে ভরে রাখবে। একটা চার্জশিট তো দিতে হবে। আমরা প্রথম দিন থেকে বলছি এটা তৃণমূল-বিজেপির বোঝাপড়া। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুঝে গিয়েছে, সিবিআই-ইডি যে সব মামলার তদন্ত করছে তাতে চার্জশিট জমা পড়বে না। একটা সময় পর্যন্ত অভিযুক্তেরা জেলে থাকবেন, তার পর ছাড়া পেয়ে যাবে। আবার চুরি-ডাকাতি চলবে।’’
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদী এবং বিচারপতি সতীশচন্দ্র শর্মার ডিভিশন বেঞ্চ শর্তসাপেক্ষে অনুব্রতের জামিন মঞ্জুর করেছে। জামিন দেওয়ার সময় শীর্ষ আদালত তিনটি শর্ত দিয়েছে। বলা হয়েছে, অনুব্রতকে পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে। পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে তাতে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং তৃতীয়ত, কোনও ভাবেই সাক্ষীদের উপর প্রভাব খাটাতে পারবেন না অনুব্রত। সিবিআই মামলায় অনুব্রত জামিন পেলেও ইডির মামলা এখনও ঝুলে দিল্লি হাই কোর্টে। তাই এখনই তিহাড় থেকে ছাড়া পাচ্ছেন না কেষ্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy