পথে নেমেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সোমবার বিষ্ণুপুর শহরে।— নিজস্ব চিত্র
ভিড় হল। সবুজ আবির উড়ল। গলা উঁচিয়ে স্লোগান রইল। যানজটও হল আগের মতোই। তবু যেন চেনা ছবিটা কিছুটা অচেনা ঠেকল।
পাঁচ বছর আগে বিধানসভা ভোটের পরে তাঁর নেতৃত্বে বিজয় মিছিল দেখেছিল বিষ্ণুপুরবাসী। সেই মিছিলের ধারা চলেছে গত লোকসভা, পুরসভা ভোটেও। সোমবার ফের একটা বিজয় মিছিল হল বিষ্ণুপুর শহরে। কিন্তু তালটা যেন কোথাও কোথাও বেসুরো ঠেকল শহরের বাসিন্দাদের কাছে।
তার কারণ অবশ্যই বিষ্ণুপুর পুরশহরে গত আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পুরপ্রধান এবং গতবারের বিধায়ক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বিধানসভা ভোটে পরাজয়। এ বারের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের প্রাক্তন এই মন্ত্রী পর্যুদস্ত হয়েছেন জোট প্রার্থী তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের কাছে। বিষ্ণুপুরের ‘স্বঘোষিত রাজা’ হিসাবে পরিচিত শ্যামবাবুর হারের পিছনে বড় কারণ তাঁর খাসতালুক খোদ বিষ্ণুপুরই! শহরের ১৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতেই বড় ব্যবধানে এ বার হেরে গিয়েছেন তিনি। তার পরেও শ্যামবাবু যে বিজয় মিছিল করবেন শহরের বুকে, তা ভাবতে পারেননি অনেকেই। কিন্তু এ দিন বিজয় মিছিল করলেন শ্যামবাবু। সেই মিছিলের পুরোভাগে হাঁটলেন। অনুগামীদের সবুজ আবিরে রাঙাও হলেন তিনি।
তার পরেও অবশ্য আক্ষেপ মিটছে না অনেক তৃণমূল নেতা-কর্মীর। মিছিলে পা মেলানো শ্যাম-অনুগামীদের অনেকেই পরে আফশোস করে বলছিলেন, “ভোটে ‘দাদা’ জেতার পরেই ধুমধাম করে বিজয় শহরে বিজয় মিছিলের পরিকল্পনা ছিল। সেই মিছিল হল ঠিকই। কিন্তু আগের সেই দাপটটা থাকল না। এ দিন দাদার মুডটাও আগের মতো ছিল না। আসলে উনি যে হেরে গিয়েছেন, এই সত্যিই এখনও তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না!’’
ভোটের আগে বিষ্ণুপুর শহরে শ্যামবাবুর ছবি সমেত পোস্টার পড়েছিল, ‘দ্য কিং ইন হিজ ওন কিংডম’। ভোটের পরে সেই পোস্টার সব উধাও। এখন চোখে পড়ছে তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা পোস্টার। বিষ্ণুপুরে গদিচ্যুত ‘রাজা’ ভোটে হেরেও কেন এই মিছিলের আয়োজন করলেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ঘটনা হল, এ বারের ভোটে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার এই বাজারেও শ্যামবাবু-সহ রাজ্যের সাত জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। হেরে যাওয়া অনেক মন্ত্রীকেই নানা পদ দিয়ে দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পাশে থাকা’র বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু, ‘পুনর্বাসন’-এর সেই তালিকায় ঠাঁই হয়নি শ্যামবাবুর। বরং তাঁর অনুগামীদের অভিযোগ, বিষ্ণুপুর পুরসভার চেয়ারম্যান পদ থেকে কী ভাবে শ্যামবাবুকে সরানো যায়, সে পরিকল্পনাও নাকি করছে জেলা তৃণমূলে তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর একাংশ!
এ হেন ‘প্রতিকূল’ পরিস্থিতিতে বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্রের গ্রামাঞ্চল থেকে কয়েক হাজার লোকজনকে শহরে এনে শ্যামবাবুর এই মিছিল নানা জল্পনার সৃষ্টি করেছে। এমনকী, জেলা তৃণমূলের অনেকেই বলছেন, “হাওয়া ফেরাতে নিজের শক্তি জাহির করার দরকার বলে বুঝেছেন খোদ শ্যামবাবুও। তাই গ্রামগঞ্জের লোকজন এনে শহর অচল করে মিছিল করার দরকার পড়ল।’’
শ্যামবাবুর এ দিনের মিছিলের জন্য কম হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়নি সাধারণ মানুষকে। বিভিন্ন লাইনের বেসরকারি বাস তুলে নেওয়া হয়েছিল গ্রাম থেকে লোক বোঝাই করে শহরে আনতে। সকাল থেকেই তাই এ দিন বিষ্ণুপুর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের ভোগান্তি চোখে পড়েছে। ওন্দা থানার পুরুষোত্তমপুর এলাকার বধূ বীণা রায় বছর দুয়েকের ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে বিষ্ণুপুরে এনেছিলেন সকালে। আসার পথে তিনি বাস পেলেও ফেরার সময় তাঁকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে এ দিক থেকে ও দিক বাসের জন্য ছুটেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বাস না থাকার কারণ। ক্ষোভ উগরে দিয়ে তিনি বলেন, “ভোটে হেরে বিজয় মিছিল কেউ করে বলে আগে শুনিনি। আবার সেই মিছিলে লোক আনতে বাসও তুলে নিয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষ যাব কোথায়?’’ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একই ক্ষোভ জানিয়েছেন সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনে বাইরে বের হওয়া বহু অফিস কর্মীরাও।
বিরোধীরাও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মনোরঞ্জন পাত্র বলেন, “ভোটে হেরে বোধহয় স্বাভাবিক বুদ্ধিটাও হারিয়ে গিয়েছে শ্যামবাবুর। না হলে জনগণ পাশে নেই জেনেও শহরে মিছিল করতেন না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘বিষ্ণুপুরবাসীর রায় জানার পরে এক মুহূর্তও আর পুরপ্রধানের পদে থাকা উচিত নয় তাঁর!’’ শ্যামবাবু নিজে অবশ্য এ সবকে পাত্তা দিচ্ছেন না। বলছেন, “আমি হেরেছি তো কী হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ফের এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। তাই বিজয় মিছিল করতেই পারি!’’ কোনও রুটের বাসও মিছিলের জন্য নেওয়া হয়নি বলে তাঁর দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy