Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

গ্রামে আধাসেনা, ভয়ে নেই ওঁরা

উর্দি পরা আধাসেনার ভারী বুটের আওয়ায় জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। বিধানসভা নির্বাচনের আগেই ফের বাঁকুড়ার এই তল্লাটের রাস্তায় ফের দেখা যেতে শুরু করেছে আধাসেনার জওয়ানদের। গত কয়েক বছরে মাওবাদী গতিবিধি আর নেই। কিন্তু এখনও জঙ্গলমহলের মানুষের মনে আতঙ্কের স্মৃতি।

করমবেড়া গ্রামে চলছে রুটমার্চ। —নিজস্ব চিত্র।

করমবেড়া গ্রামে চলছে রুটমার্চ। —নিজস্ব চিত্র।

দেবব্রত দাস
রাইপুর শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০১:০৮
Share: Save:

উর্দি পরা আধাসেনার ভারী বুটের আওয়ায় জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। বিধানসভা নির্বাচনের আগেই ফের বাঁকুড়ার এই তল্লাটের রাস্তায় ফের দেখা যেতে শুরু করেছে আধাসেনার জওয়ানদের। গত কয়েক বছরে মাওবাদী গতিবিধি আর নেই। কিন্তু এখনও জঙ্গলমহলের মানুষের মনে আতঙ্কের স্মৃতি। বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের নিরাপত্তা দিতে আসা বাহিনী, ফেলে আসা মাওবাদী আতঙ্কেই আর এক পরত স্বস্তি দিল জঙ্গলমহলের মানুষকে।

জেলার এই অঞ্চলে আগে থেকেই মোতায়েন ছিল দুই কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। বারিকুলের সারেংসোগড়া ক্যাম্পে ছিলেন সিআরপিএফের ১৬৯ জি এবং ঝিলিমিলি ক্যাম্পে সিআরপিএফের ১৬৯ এফ ব্যাটেলিয়নের জওয়ানরা। গত মঙ্গলবার বিধানসভা নির্বাচনে নিরাপত্তা আগাম নিশ্চিত করতে এসে পৌঁছেছে সিরাপিএফের ১৯৭ বি ব্যাটেলিয়ানের জওয়ানরাও। বারিকুলের মাজগেড়িয়া ক্যাম্পে রাখা হয়েছে তাঁদের। বুধবার থেকেই জঙ্গলমহলের গ্রামে গ্রামে রুটমার্চ শুরু করেছেন তাঁরা।

বৃহস্পতিবার সকালেও কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওই তিন কোম্পানি জওয়ান বারিকুল, রাইপুর এবং রানিবাঁধ এলাকায় প্রায় বারো কিলোমিটার রুটমার্চ করেছেন। এ দিন সকালে নতুন আসা ব্যাটেলিয়নের জওয়ানরা মাঝগেড়িয়া ক্যাম্প থেকে গাড়িতে রাইপুর থানা এলাকায় যান। সকাল ১০টা নাগাদ রাইপুরের সোনাগাড়া পঞ্চায়েতের করমবেড়া গ্রামে পৌঁছন তাঁরা। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের মোরাম রাস্তার উপর দিয়ে শুরু হয় রুটমার্চ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাইপুর থানার এক আধিকারিক। তেঁতুলডাঙা, সর্দারপাড়া, শবরপাড়া, সাঁওতালপাড়ার ভিতরের রাস্তা দিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার মার্চ করেন তাঁরা। এর পর করমবেড়া গ্রাম থেকে মাঠের আলপথ ধরে মুরকুম গ্রামে পৌঁছয় বাহিনী। সেখান থেকে সোনাগাড়া, বড়গড়া, পুকুরিয়া গ্রামের ভিতরের ভিতরের রাস্তায় চলে রুটমার্চ। সবমিলিয়ে রাইপুর থানা এলাকায় এ দিন প্রায় ১২ কিলোমিটার রুটমার্চ করেছে কেন্দ্রীয়বাহিনী। তবে রুটমার্চের সময় গ্রামের মানুষের সঙ্গে জওয়ানেরা বিশেষ কথাবার্তা বলেননি। শুধু সর্দারপাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় বাসিন্দা নীলমণি সিংহ সর্দারের কাছে গ্রামটির নাম জানতে চেয়েছিলেন কয়েকজন জওয়ান। তারপর আর কথা বাড়াননি।

সারেংসোগড়া ক্যাম্পের জওয়ানরা এ দিন বারিকুল থানার শুশুনিয়া, শিমুলপাল এবং রসপাল এলাকায় রুটমার্চ করেন। অন্য দিকে এ দিন দুপুরে ঝিলিমিলি ক্যাম্পের আধাসামরিক বাহিনীর একটি দলকে রানিবাঁধের আকখুটা মোড়ে মোতায়েন রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে খাতড়া-রানিবাঁধ রাস্তা দিয়ে রানিবাঁধ পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার রুটমার্চ করেন তাঁরা। তবে কোনও ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে তাঁদের ভয়-ভীতি নিয়ে কোনও কথা বলেননি জওয়ানরা।

সরকারি ভাবে মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা হিসাবে চিহ্নিত দক্ষিণ বাঁকুড়ার বারিকুল, রানিবাঁধ, রাইপুর, সারেঙ্গা থানা। নির্বাচনের আগে জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদীদের নাশকতা চালানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে গোয়েন্দা দফতর সূত্রের খবর। তাই স্পর্শকাতর বুথগুলিতে নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি তৈরি করতে চায় প্রশাসন। কিন্তু সকালে বাড়ির সামনে আধা সেনার রুটমার্চ দেখে কিছুটা অবাক জঙ্গলমহলের মানুষ। তবে আগের মত করমবেড়া, তেঁতুলডাঙার মতো বিভিন্ন গ্রামের মানুষ জওয়ানদের দেখেই বাড়ির ভিতর সেঁধিয়ে যাননি। উল্টে অনেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে জওয়ানদের দেখেছেন। কেউ আবার পিছু পিছু খানিকটা এগিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন কোন দিকে যাচ্ছেন জওয়ানেরা। আগের সেই ভয়ের ছাপ এখন আর জঙ্গলমহলের মানুষের চোখে মুখে নেই। করমবেড়া গ্রামের সত্যবান মুর্মু, দুর্লভ মুর্মুরা বলেন, “বনপার্টির লোকজন আগে জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামে আসত। এখন আর আসে না। পরিস্থিতি এখন বদলেছে। আধাসেনা এসেছে দেখে আমাদের বলভরসা কিছুটা বাড়ল বৈকি।”

এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে কমিশনের স্লোগান, ‘বিবেচনার সঙ্গে নির্ভয়ে ভোট দিন।’ স্থানীয় বাসিন্দাদের একাশের দাবি, অন্য জেলার জঙ্গলমহল এলাকার থেকে বাঁকুড়ার এই তল্লাট কিছুটা আলাদা। রাজনৈতিক সন্ত্রাস এখানে তুলনায় অনেক কম। এখানে আতঙ্ক ছিল শুধুই মাওবাদী সন্ত্রাসের। শুশুনিয়া গ্রামের হপন মান্ডি, সুধনী মান্ডিরা বলেন, “ভয় আমাদের একটা পার্টিকেই। বনপার্টি। অন্য কোনও পার্টির কেউ আমাদের ভয় দেখাতে আসেনি। এত জওয়ান এসেছে। এখন ভয়ের কিছু নেই আর।”

কেন্দ্রীয় বাহিনীর আগে ভাগে চলে আসাতে খুশি বিরোধীরা। তবে সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অজিত পতির অভিযোগ, “জঙ্গলমহলের পুলিশ আধিকারিকরা এখন তৃণমূলের দালালি করছেন। সেই আধিকারিকদেরই সঙ্গে নিয়ে রুটমার্চ করছে বাহিনী। মানুষ নির্ভয়ে ভোট দেবেন কী করে!’’ তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা কোর কমিটির সদস্য অরূপ চক্রবর্তী পাল্টা মন্তব্য, “কেন্দ্রীয় বাহিনী জঙ্গলমহলে রয়েছে। আর আমাদের সঙ্গে রয়েছেন জঙ্গলমহলের মানুষ। শূন্য হাতে ফিরতে হবে বুঝেই ওরা ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে।’’

জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, এলাকা চেনানোর জন্য আপাতত রুটমার্চ করানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। রাস্তাঘাট চেনানো এবং ভাষাগত সমস্যা দূর করার জন্য স্থানীয় থানার এক জন আধিকারিক তাঁদের সঙ্গে থাকছেন। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, আগামী ৭ মার্চের মধ্যে বাঁকুড়ায় আরও চার কোম্পানি আধাসেনা আসার কথা রয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

paramilitary force villagers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE