আপৎকালীন পরিষেবা দেওয়ার লাইন মাস সাতেক ধরে কাটা। মূল লাইনেও মাঝে মধ্যেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে গত এক মাস ধরে পুরুলিয়া সদর তো বটেই, সারা জেলা জুড়ে বিএসএনএলের পরিষেবা কার্যত শিকেয় উঠেছে। এমনই অভিযোগ তুলেছেন বিএসএনএল গ্রাহকেরা। মোবাইল পরিষেবা তো বটেই, ল্যান্ডফোন থেকে ব্রডব্র্যান্ড পরিষেবাতেও দফায় দফায় বিঘ্ন ঘটছে। যদিও বিএসএনএলের জেলা আধিকারিকদের তরফে এই সঙ্কটমুক্তির স্পষ্ট দিশা পাওয়া যায়নি। অনেকে বেসরকারি মোবাইল পরিষেবা ঠিক থাকলেও বিএসএনএলের ক্ষেত্রে বারবার এই বিপর্যয়ে ‘অন্তর্ঘাতে’র সন্দেহও করছেন।
কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নেটওয়ার্ক উধাও, কখনও সংযোগ মিললেও আচমকা লাইন কেটে যাওয়া, কখনও বা সংযোগ পাওয়ার পরেই স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ‘কানেকশন এরর’। মোবাইলে ফোন করতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতা পুরুলিয়া জেলার বিএসএনএল গ্রাহকদের। ক’দিন আগেই এক সকাল থেকেই পুরুলিয়া শহরে আচমকা অচল হয়ে পড়ে বিএসএনএলের মোবাইল পরিষেবা। ফোন প্রায় অকেজো হয়ে ছিল। পরিষেবা স্বাভাবিক হতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হয়, তেমনই প্রশাসনিক কাজেরও ব্যাঘাত ঘটে।
বিএসএনএলের জেলা আধিকারিকদের ব্যাখ্যা, পুরুলিয়া জেলার বিএসএনএল পরিষেবা বাঁকুড়া থেকে অপ্টিক্যাল ফাইবার লাইনে জোড়া রয়েছে। ওই রুটে গোলমাল হলে পরিষেবায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সে জন্য আসানসোল থেকে একই ভাবে অপটিক ফাইবারের মাধ্যমে একটি বিকল্প লাইন পুরুলিয়ায় টানা হয়েছে। কিন্তু ওই রুটের রঘুনাথপুর ও নিতুড়িয়ার মধ্যে অপটিক ফাইবারের তার প্রায় সাতমাস খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। এ দিকে, ছাতনার কাছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে মূল লাইনের তার কাটা পড়েছে। ফলে পরিষেবা অচল হয়ে পড়েছে। বিকল্প ব্যবস্থাও অকেজো থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ছে বিএসএনএল পরিষেবা।
পুরুলিয়া শহর যেমন সপ্তাহখানেক আগে ভুগল, তেমনই জেলার অন্যান্য ব্লকের মানুষজনকেও গত কয়েকদিন ধরে মাঝে মধ্যেই নেটওয়ার্ক না পেয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অপ্টিক্যাল ফাইবার কাটা পড়া ছাড়াও নানা রকম রোগে আক্রান্ত জেলার বিএসএনএল পরিষেবা। লোডশেডিং হলেও নেটওয়ার্ক উধাও হয়ে যাচ্ছে। কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়া বলেন, ‘‘প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য বিএসএনএল পরিষেবার উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু বিএসএনলের টেলিপরিষেবা কার্যত নিয়ম করে অচল হয়ে পড়ছে।’’ তাঁর অভিযোগ, গত দু-তিন মাসে বেশ কয়েকবার দিনভর টেলিপরিষেবা অচল হয়ে ছিল। দফতরের আধিকারিকরা জানান, এ দিন অমুক জায়গায় লাইন কেটে গিয়েছেন, অন্যদিন অন্য জায়গায় লাইন কেটে গিয়েছে বলে শুনতে হয়। বাঘমুণ্ডির বাসিন্দা প্রশান্ত মাহাতোর কথায়, ‘‘বিরক্ত হয়ে এখন বিএসএনএল সংযোগ ছেড়েই দিয়েছি।’’
আর পরিষেবার এমন বেহাল অবস্থায় দিনে দিনে বিএসএনএলের গ্রাহকের সংখ্যা কমছে পুরুলিয়ায়। দফতর সূত্রের খবর, গত এক বছরে কুড়ি হাজারেরও বেশি বিএসএনএল গ্রাহক তাঁদের মোবাইল সংযোগ ছেড়ে দিয়েছেন। পরিষেবার জেরে প্রভাব পড়েছে ল্যান্ডলাইনেও। অনেকেই তাঁদের ল্যান্ডলাইনও ছেড়ে দিয়েছেন।
ডব্লুএলএল পরিষেবার অবস্থাও খারাপ। গ্রাহকদের অনেকেরই অভিযোগ, তাঁরা সমস্যা নিয়ে অফিসে গেলে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। দফতর সূত্রের খবর, এক সময় এই পরিষেবার গ্রাহকের সংখ্যা চার হাজারের বেশি থাকলেও এখন গ্রাহকের সংখ্যা নেমেছে হাজারেরও নীচে। এই বিভাগ দেখার জন্য দফতরের কাউকে দায়িত্বও দেওয়া নেই। ব্রডব্যান্ড নিয়েও কম অভিযোগ নেই। খোদ জেলা শহরেই ব্রডব্যান্ডের নির্দিষ্ট স্পিড মিলছে না। বীরবল মোদক নামে পুরুলিয়ার এক গ্রাহকের অভিজ্ঞতা, ‘‘মাঝেমধ্যেই ব্রডব্যান্ডের সংযোগ চলে যায়। স্পিড কখনও ভাল কখনও মন্দ।’’ ব্যাঙ্কেও এ কারণে গ্রাহকদের ভুগতে হচ্ছে।
মোবাইল পরিষেবা যে টাওয়ার বা বিটিএস-র উপর নির্ভরশীল, তার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও কর্মীদের একাংশের মধ্যেই অভিযোগ উঠেছে। পুরুলিয়া জেলায় কয়েকশো বিটিএস রয়েছে। তার অন্তত ২৫ শতাংশ সপ্তাহের বেশিরভাগ সময় ডাউন থাকে বলে অভিযোগ। কিন্তু কোনও বিটিএস অচল হয়ে গেলে বা ডাউন হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আধিকারিকদের মোবাইলে সে সম্পর্কে এসএমএস চলে যায়। গ্রাহকদের প্রশ্ন, সেই তথ্য আধিকারিকদের কাছে পৌঁছানোর পরেও কী ভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকী কখনও বা টানা দু’-তিনদিন ধরে বিটিএস অচল থাকে কী করে? কর্মীদেরও একাংশের প্রশ্ন, অপটিক ফাইবার দেখার পৃথক শাখা রয়েছে, রক্ষণবেক্ষণেরও পৃথক শাখা রয়েছে, পাশাপাশি ঝালদা, মানবাজার, পুরুলিয়া ও আদ্রায় দফতরের গাড়ি-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো রয়েছে, কর্মীও রয়েছে, রয়েছে অস্থায়ী কর্মীও, লক্ষ লক্ষ টাকা বিদ্যুতের বিল বাবদ খরচ হচ্ছে, তবুও পরিষেবার এই হাল কেন? জেলা টেলিকম কর্মীদের একটি সংগঠনের নেতা প্রেমকুমার সিংহ অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘কর্মীরা ভাল পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে সব এলাকায় অভিযোগ উঠেছে, সেখানকার বিষয়টি আধিকারিকদের দেখা দরকার।’’
ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান বিএসএনএলের সংযোগ ছেড়ে বেসরকারি সংস্থায় চলে গিয়েছে। পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক সুবলচন্দ্র দে বলেন, ‘‘মাঝে এক শনিবার বিভিন্ন কলেজে পরীক্ষা চলছিল। কিন্তু, আমার বিএসএনএলের মোবাইল সারাদিন কাজ করেনি। সে দিন কী অসহ্য অবস্থায় কেটেছে বলে বোঝানো যাবে না! কোথাও অন্তর্ঘাতের জন্য পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে না তো? এটাও দেখা দরকার।’’ বিএসএনএল নম্বর থাকার পরেও সম্প্রতি বিভিন্ন ব্লকের প্রশাসনিক আধিকারিক-সহ জেলাপ্রশাসনের আধিকারিকদের বেসরকারি মোবাইল সংযোগ দেওয়া হয়েছে। জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তীর কাছে বিএসএনএলের পরিষেবার মান সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে তিনি হেসে বলেন, ‘‘কী আর বলব! পরিষেবা মান আরও ভাল হওয়া দরকার।’’ জেলা টেলিকম অ্যাডভাইসারি কমিটির চেয়ারম্যান তথা পুরুলিয়ার সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতো বলেন, ‘‘পরিষেবার মান নিয়ে কী বলব? প্রচুর অভিযোগ আসছে। কিন্তু সমস্যাগুলো নিয়ে যে আলোচনা করব, বিএসএনএলের তো এখনও পর্যন্ত বৈঠকও হয়নি।’’
জেলা টেলিকম আধিকারিক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি মাসখানেক হল দায়িত্ব নিয়েছি। পরিষেবার মান যতটা সম্ভব ভাল করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেব্ল কেটে দিলে আমাদের কিছুই করার নেই।’’ কিন্তু বিকল্প লাইন কেন সারানো হচ্ছে না? তিনি বলেন, ‘‘ওই লাইন সারানো হবে।’’ কিন্তু কবে, সদুত্তর নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy