রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে পরিজনেরাই ভরসা।—নিজস্ব চিত্র
জেলা হাসপাতাল বলে ঘোষণা হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। ধাপে ধাপে হাসপাতালের পরিকাঠামোর মান উন্নত হলেও বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের পরিষেবার মান নিয়ে ক্ষোভ মিটছে না রোগী ও রোগীর পরিবারের লোকজনদের। মুমূর্ষু রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামানো থেকে শুরু করে ইনডোরে নিয়ে যাওয়া, বেডে তোলা— সব কিছু রোগীর আত্মীয়দেরই দায়িত্ব নিয়ে করতে হয় বলে অভিযোগ। মাঝে মঝে স্টোর থেকে বয়ে নিয়ে আসতে হয় অক্সিজেন সিলিন্ডারও। শুধু যে রোগীরাই সমস্যায় পড়ছেন, তা নয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও হাতে গোনা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়ে হাসপাতাল চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কয়েকটি উদাহরণ দিলেই রোগীর পরিবারের নাকাল হওয়ার ছবিটা স্পষ্ট হবে। ওয়ার্ড থেকে দৌড়ে এসে জরুরি বিভাগের সামনে হাঁফাতে হাঁফাতে মাঝবয়সী অরিন্দম দুবে একে তাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডারের স্টোর কোন দিকে। এক হাসপাতালের কর্মী তাঁকে নিয়ে গেলেন স্টোরে। সেখান থেকে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বের করে দেওয়া হল। কিন্তু সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়ার লোক নেই। অগত্যা অরিন্দমই সিলিন্ডার ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলেন মহিলা বিভাগে। গোয়ালতোড় থানার বাসিন্দা ওই যুবকের আক্ষেপ, “শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঠাকুমা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তার বললেন এখনই অক্সিজেন দিতে হবে। ওয়ার্ডে কোনও গ্রুপ ডি কর্মী না থাকায় স্টোর থেকে আমাকেই সিলিন্ডার বয়ে নিয়ে যেতে হল ওয়ার্ডে।’’
কিছুদিন আগের কথা। অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতরে এক মুমূর্ষু রোগীর স্যালাইন চলছে। গাড়ি থেকে তাঁকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোকের দরকার। জরুরি বিভাগে গিয়ে ওই রোগীর এক আত্মীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর খোঁজ করলেন। কিন্তু, কেউ নেই। শেষে হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোকজনকে স্ট্রেচার বওয়ার অনুরোধ করে কোনও মতে ইমারজেন্সি পর্যন্ত ঢোকানো গেল রোগীকে। ওই আত্মীয়ের ক্ষোভ, জেলা হাসপাতালে এসেও রোগীদের বইতে লোক ডাকতে হচ্ছে।
আউটডোরের একটি বিভাগের সামনে লম্বা লাইন। কিন্তু, লাইন এগোচ্ছে ঢিমে তালে। এ নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীদের অনেকেই ক্ষুব্ধ। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যেই ডাক্তার ইচ্ছে করে দেরি করছেন বলে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। সমস্যাটা কোথায়? বিরক্তির সুরে কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, “চতুর্থ শ্রেণির কর্মী আসেনি। তাই একা হাতে রোগী দেখা থেকে রেজিস্টার ও স্লিপ লেখা সবই করতে হচ্ছে। দেরি তো হবেই।’’
অথচ জেলা হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণা হওয়ার পরে ধাপে ধাপে এখানে চালু হয়ছে বার্ন ইউনিট থেকে ডিজিটাল এক্স রে-র ব্যবস্থা। গড়ে উঠেছে অসুস্থ নবজাতকদের চিকিৎসার জন্য এসএনসিইউ। বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের ইনডোরের ছ’টি ওয়ার্ডের পাশাপাশি আউটডোরে প্রায় ১২টি বিভাগ রয়েছে। গোটা হাসপাতাল পরিচালনার জন্য অন্তত ১০০ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী দরকার বলে জানাচ্ছেন হাসপাতালের কর্তারা। সেখানে রয়েছেন পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে ৩২ জন স্থায়ী ও ২০ জন অস্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। এ ছাড়া ১২ জন সুইপার বা সাফাইকর্মী। সকলেই শিফটে ডিউটি করেন। কর্মীদের মধ্যে আবার আগাম না জানিয়ে ছুটি নেওয়ার প্রবণতাও রয়ছে। সে ক্ষেত্রে সমস্যা মেটাতে অনেক সময় হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মীদেরই চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক সময় আবার স্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের কেউ কেউ দিনের পর দিন হাসপাতালে না এসে অন্য কাউকে হাসপাতালে পাঠিয়ে তাঁর কাজ করান বলে অভিযোগ ওঠে।
যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হাসপাতাল সুপার পৃথ্বীশ আকুলি। তবে পর্যাপ্ত সংখ্যক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী না থাকায় হাসপাতাল পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে বলে অবশ্য তিনি মানছেন। পৃথ্বীশবাবুর কথায়, “গ্রুপ ডি কর্মীর অভাব রয়েছে। তার ফলে হাসপাতাল পরিচালনায় নানা ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে। আউটডোর বা ইনডোরে চাহিদামতো চতুর্থ শ্রেণির কর্মী দিতেও নাজেহাল হতে হচ্ছে আমাদের। স্বাস্থ্য ভবন এই সমস্যার কথা জানে।’’ পর্যাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মী না থাকায় হাসপাতালে আসা রোগী বা রোগীর আত্মীয়েরা যে সমস্যায় পড়ছেন, তা মানছেন এই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য তথা বিষ্ণুপুর পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “রাজ্যে পালাবদলের পর এই হাসপাতালের পরিকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তবে হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী অবিলম্বে নিয়োগ করা দরকার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ রোগী, দু’পক্ষই সমস্যায় পড়ছে। স্বাস্থ্য ভবন শীঘ্রই এ বিষয়ে পদক্ষেপ করবে বলে আমরা আশাবাদী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy