পরিস্থিতি: তাপস বাউড়ির মা সখী বাউড়ি। (ইনসেটে) বিষ্ণুপুর আদালতে ধৃত তমালকান্তি গুঁই। নিজস্ব চিত্র
পেট ফুঁড়ে দিয়েছে গুলি। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাদ্যনালী ও কিডনি। অস্ত্রোপচারের পরেও তাই পাত্রসায়রের হাটকৃষ্ণনগরের বছর চোদ্দোর সৌমেন বাউড়িকে নিয়ে চিকিৎসকদের উদ্বেগ কাটছে না। তাকে রাখা হয়েছে মেডিক্যালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। ছেলের জন্য হাসপাতাল চত্বরে কার্যত হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বাবা-মা কেষ্ট বাউড়ি ও মঞ্জু বাউড়ি।
সৌমেনের জেঠতুতো দাদা বছর ত্রিশের তাপস বাউড়ির ডান কাঁধ ঘেঁষে গুলি চলে গিয়েছে। হাসপাতাল চত্বরে রয়েছেন তাঁর বাবা দিলীপ বাউড়ি। বাড়িতে উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষায় মা সখী বাউড়ি।
গলায় গুলির ক্ষত নিয়ে বাঁকুড়া মেডিক্যালেই ভর্তি সৌমেনদের পড়শি টুলুপ্রসাদ খাঁ-ও। পরিবারের লোকজন বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে তাঁর চিকিৎসা করাতে চলে গিয়েছেন।
শনিবার বিকেলে পুলিশের সঙ্গে বিজেপি কর্মীদের সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাত্রসায়রের কাঁকড়ডাঙামোড়। চলে বোমাবাজি। গুলিও। কয়েক ঘণ্টা ধরে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা সেই মোড়ে রবিবার সকালে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। জনবহুল এলাকা একেবারে সুনসান। রাস্তায় শুধু পুলিশের টহল। দোকানপত্র খোলা থাকলেও খদ্দেরদের দেখা নেই বললেই চলে।
সেখান থেকেই কয়েকশো মিটার দূরে হাটকৃষ্ণনগরের বাউড়িপাড়া তখন শোক ছাপিয়ে ক্ষোভে ফুটছিল। পুলিশকেই গুলি চালানোর জন্য দুষে গোলমালের জন্য দায়ী করছিলেন বাসিন্দারা। তাপসের মা সখীদেবী বলছিলেন, ‘‘শনিবার বিকেলে দেওরের ছেলে সৌমেন পাত্রসায়র থেকে টিউশন পড়ে ফিরছিল। আমার ছেলে তাপস গাড়ি নিয়ে ফিরছিল। সেই সময় পুলিশ ওদের উপরে গুলি চালায়। তাপস ইদানীং বিজেপি করলেও সৌমেন রাজনীতির সাতে-পাঁচে ছিল না। তাকে কেন গুলি করল পুলিশ?’’
পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাওয়ের দাবি, পুলিশ গুলি ছোড়েনি। জমায়েত থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতে পুলিশ পাড়ায় টহল দিলেও রবিবার দিনের বেলায় একবারও খোঁজ নিতে আসেনি তাঁদের। এত বড় ঘটনার পরে প্রশাসনের লোকেরাও কেন আসেনি? তাঁদের আক্ষেপ, তবে কার কাছে সুবিচার চাইতে তাঁরা যাবেন? সৌমেনদের এক আত্মীয় বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে যাব কোন ভরসায়? মিথ্যা মামলায় হয়তো গারদে ভরে দেবে!’’
কাঁকরডাঙা মোড়ের কাছেই বাড়ি বিজেপির পাত্রসায়র ২ মণ্ডল সভাপতি তমালকান্তি গুঁইয়ের। সেখানেই তাঁর রেডিমেড পোশাকের দোকান। তাঁর স্ত্রী শাশ্বতী গুঁইয়ের দাবি, ‘‘গোলমালের সময় স্বামী দোকানের ভিতরেই ছিলেন। পুলিশ সেখান থেকে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গণ্ডগোলের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে রাস্তায় ফেলে মারধর করল। সারারাত কোথায় স্বামীকে রেখেছিল, কিছুই জানতে পারিনি। সকালে থানায় খোঁজ করতে গেলে, পুলিশ জানায় গণ্ডগোলে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অবিচার করা হচ্ছে।’’ বিজেপির বিষ্ণুপুর জেলা সাংগঠনিক সভাপতি স্বপন ঘোষ দাবি করেন, ‘‘মিথ্যা মামালায় এ ভাবে বিজেপিকে আটকানো সম্ভব নয়। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সব তথ্য পাঠানো হচ্ছে।”
এলাকাবাসীর একাংশের প্রশ্ন, ‘‘পুলিশকে গুলি চালানোর অর্ডার কে দিল? কোনও তৃণমূল নেতা না কি কোনও পুলিশ অফিসার?’’ এ দিন এলাকায় গিয়েছিলেন বিজেপির রাঢ়বঙ্গের বিস্তার প্রমুখ সুজিত অগস্তি। তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘তৃণমূলের লোকেরাই বোমা ছুড়েছে। আমাদের লোকেদের হাতে বোমা বা কোনও অস্ত্র নেই।’’ যদিও ব্লক তৃণমূল সভাপতি পার্থপ্রতিম সিংহের দাবি, ‘‘তৃণমূল ওই গোলমালে কোনও ভাবেই জড়িত নয়। বিজেপিই পুলিশের সঙ্গে গোলমাল করেছে।’’ সিপিএমের পাত্রসায়রের এরিয়ার সম্পাদক লালমোহন গোস্বামীর মন্তব্য, ‘‘গুলি চালানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবুও পুলিশ কেন গুলি চালাল? এক জন ছাত্রও রেহাই পেল না। এ থেকে স্পষ্ট পুলিশের মনোভাব।’’
এ দিকে এই ঘটনায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পাত্রসায়রের বাসিন্দারা। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে রাজ্যে পালাবদলের আগে পর্যন্ত টানা দু’বছর বোমা, গুলিতে বারবার অশান্ত হয়েছে পাত্রসায়র। কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মী খুন হন। লাগাতার পথ অবরোধ, বন্ধে জনজীবন জেরবার হয়।
এ বার লোকসভা নির্বাচনে জেলার দু’টি কেন্দ্রই হারিয়েছে তৃণমূল। পাত্রসায়র ব্লকের দু’টি পঞ্চায়েত বাদে বাকিগুলিতে ভোটের ফলের বিচারে এগিয়ে বিজেপি। সেই থেকে ফের অশান্তি শুরু হয়েছে। আবার কি সেই দশ বছর আগের অশান্ত দিনে ফিরে যেতে হবে পাত্রসায়রের মানুষজনকে— এই প্রশ্নই ঘুরছে এলাকায়।
তথ্য সহায়তা: অভিজিৎ অধিকারী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy