Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

প্রবাসীর কাছে ইন্টারনেটে গাজনের যাত্রা

শুরুটা হয়েছিল ৬০ বছর আগে। সেই আমলে যাত্রা হত পঞ্চকোট রাজবাড়ির অন্দরমহলের আসর। রাজবাড়ির কয়েক জন কর্মী ঠিক করলেন, রাজবাড়ির সেই বিনোদনকে নিয়ে আসবেন আমজনতার মাঝে।

চলছে পালা। —নিজস্ব চিত্র

চলছে পালা। —নিজস্ব চিত্র

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১৫
Share: Save:

শুরুটা হয়েছিল ৬০ বছর আগে। সেই আমলে যাত্রা হত পঞ্চকোট রাজবাড়ির অন্দরমহলের আসর। রাজবাড়ির কয়েক জন কর্মী ঠিক করলেন, রাজবাড়ির সেই বিনোদনকে নিয়ে আসবেন আমজনতার মাঝে। গাজনের মেলায় যাত্রাপালা অভিনয়ের জন্য কোমর বাঁধলেন রাঙামাটি যুব সমিতির সদস্যেরা। মাঠে মঞ্চ বেঁধে অভিনীত হল ‘ধনুর্যজ্ঞ’ পালা।

তার পরে, গত ছ’ দশকে এলাকার মানুষজনের কাছে গাজন আর যাত্রা প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। দ্বারকেশ্বের তীরে কাশীপুর ব্লকের রাঙামাটি গ্রামে গাজনের মেলায় তার পর থেকে প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন এবং তার আগের দিন যাত্রাপালা অভিনীত হয়ে আসছে। এই বছর মঞ্চস্থ হয়েছে ‘পরশ পাথর’ এবং ‘মা মাটি মানুষ’ নামে দু’টি পালা।

বিনোদনের হাজারো মাধ্যম যখন দোরগোড়ায় হাজির, যাত্রাকে ঘিরে এই গ্রামের বাসিন্দাদের উৎসাহে খামতি দেখা যায়নি কখনও। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে পালার নির্দেশনা করে আসছেন চঞ্চল দুবে। তাঁর দাবি, গ্রামের যে সমস্ত বাসিন্দারা এখন বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকেন, তাঁদের জন্য যাত্রার ভিডিও তুলে ইন্টারনেটে পাঠাতে হয়। হায়দ্রাবাদ, জামশেদপুর, রাঁচি বা বেঙ্গালুরুতে বসে মোবাইলে সেই যাত্রা দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটান তাঁরা। বিনোদনের যতই নিত্যনতুন মাধ্যম আসুক না কেন, এই যাত্রার সঙ্গে মিশে আছে এলাকার শিকড়ের টান। এমনটাই মনে করেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের মতে রাঙামাটি যুব সমিতি গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে অনেক চাওয়া পাওয়ার স্বপ্ন। এই প্রসঙ্গে তাঁরা তুলে আনেন যাত্রা শুরুর ইতিহাস। পঞ্চকোট রাজপরিবারে সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটকের বিশেষ কদর ছিল। স্বয়ং রাজা শঙ্করীপ্রসাদ অভিনয় করতে ভালবাসতেন। রাজবাড়ির নাটকে রাজার সঙ্গে অভিনয় করতেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ দুবে। রাঙামাটি গ্রামের বাসিন্দা রাজেন্দ্রলাল দুবে এবং কৃষ্ণকিশোর দুবে ছিলেন রাজবাড়ির কর্মচারি। তাঁরা সবাই মিলে তৈরি করেছিলেন রাঙামাটি যুব সমিতি। রাজবাড়ির রোশনাই, আভিজাত্য, প্রাচুর্যের বাইরে শিল্পকে সাধারণ গরিব মানুষের দরবারে হাজির করতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

চঞ্চল দুবে জানান, প্রথম যাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেরই বয়ে স হয়েছে। অনেকই এখন বেঁচে নেই। পরের প্রজন্ম বহন করছে উত্তরাধিকার। দীর্ঘদিন পালায় অভিনয় করছেন মৃত্যুঞ্জয় দুবে। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি, তখন বেশির ভাগ পৌরাণিক পালাই হত। গাজনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই এলাকায় সাড়া পড়ে যেত। কোন পালা হবে তাই সবার কৌতুহল থাকত। আজও আমরা পালা মঞ্চস্থ করতে গিয়ে সেই রোমাঞ্চটা আমরা বুঝতে পারি।’’

শ্যামচাঁদ দুবের বয়স এখন ষাটের কোঠায়। এক কালে বছরের পর বছর চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। এখন আর শরীর সায় দেয় না। তবু গাজনের সময় এলে এখনও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না তিনি। শ্যামচাঁদবাবু বলেন, ‘‘অভিনয় করতে না পারি, যাঁরা করছে তাঁদের সাহায্য তো করতে পারি!’’ চঞ্চলবাবুও জানান, সেই আমলের সবাই অভিনয় না করলেও তাঁদের পাশে থাকেন। হাতে হাতে সাহায্য করেন। পরাপর্শ দেন। প্রবীণের সেই সাহায্য নবীনের উৎসাহ বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ।

উদ্যোক্তারা জানান, প্রতি বছর দু’টি পালার শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে কৃষ্ণকিশোর দুবে স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হয়। এই বছরের মঞ্চ থেকে অতীতে গাজনের যাত্রায় অভিনয় করেছেন এমন পঞ্চাশ জন প্রবীণ শিল্পীর হাতে স্মারক তুলে দিয়ে তাঁদের সম্মানিত করার আয়োজন করেছিলেন উদ্যোক্তারা।

এখন দিন অনেক বদলেছে। প্রবীণ শিল্পী প্রকৃতেশ্বর পরামাণিক ফেলে আসা দিনের স্মৃতি খুঁড়ে চলেন। বলেন, ‘‘তখন পেশাদার অভিনেত্রী পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন পুরুষরাই। অভিনয়ে দর্শকরা সেই ফাঁকটুকুর কথা মনেও আসত না।’’ পেশার তাগিদে গ্রামের বাইরে থাকেন রঞ্জিৎ দুবে। তিনি বলেন, ‘‘গাজন এলেই মনটা উড়ুউড়ু করতে থাকে। ফেরার দিন গুণি। গাজনের যাত্রা দেখার আনন্দটাই আলাদা। অন্য পালা দেখে এই আশ মেটে না।’’

এই টানটুকুই এখন ভরসা রাঙামাটি যুব সমিতির। উদ্যোক্তাদের দাবি, যাত্রার প্রতি আগ্রহ অন্য এলাকার মানুষের কমে এলেও, এই গ্রামের মানুষ গাজনের যাত্রাকে ঘিরে উন্মাদনা কখনও কমার নয়। কারণ এই যাত্রাকে ঘিরে গ্রামের আকাশে বাতাসে বেজে ওঠে ঘরে ফেরার গান। নতুন বছরে পা দেওয়ার আগে সবাই মিলে জড়ো হন মেলার মাঠে। সেই মাঠ, যেখানে অনেক অনেক বছর আগে, এমন দিনে যাত্রা দেখতে বসতেন তাঁদের বাপ ঠাকুরদারা। উত্তরপুরুষরা সেই মাটির গভীর থেকে শুষে নেন শিল্প-সংস্কৃতির পরম্পরা।

অন্য বিষয়গুলি:

Internet Gajan fair
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE