Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ডাক আসে না, স্মৃতিই সম্বল পালকি পাড়ার

শিশুপাঠ্য থেকে তো কবেই উধাও হয়ে গিয়েছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’। ‘হুম না, হুম না’ বলে মাঠ কাঁপিয়ে পালকির সে গানও আজ বিস্মৃত! অনভ্যাসে পালকি বাহকেরাও ভুলতে বসেছেন তাঁদের নিজস্ব ঘরানার সে গানের কথা ও সুর। স্মৃতিতে কখনও সখনও সে গানের সুর জেগে উঠলেও বা, কেমন যেন উদাস হয়ে যান সুকুমার বাউড়ি, মহাদেব বাউড়িরা।

ভেঙে গিয়েছে পালকি। তবু এখনও সাফসুতরো করা হয় আগের মতোই। ছবি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

ভেঙে গিয়েছে পালকি। তবু এখনও সাফসুতরো করা হয় আগের মতোই। ছবি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০১:২১
Share: Save:

শিশুপাঠ্য থেকে তো কবেই উধাও হয়ে গিয়েছে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’।

‘হুম না, হুম না’ বলে মাঠ কাঁপিয়ে পালকির সে গানও আজ বিস্মৃত! অনভ্যাসে পালকি বাহকেরাও ভুলতে বসেছেন তাঁদের নিজস্ব ঘরানার সে গানের কথা ও সুর। স্মৃতিতে কখনও সখনও সে গানের সুর জেগে উঠলেও বা, কেমন যেন উদাস হয়ে যান সুকুমার বাউড়ি, মহাদেব বাউড়িরা। কেননা, পালকির প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে আজ কেবল রয়ে গিয়েছে পালকি পাড়ার খেতাব। ওই খেতাবই নস্টালজিক করে তোলে সুকুমার বাউরিদের।

নানুরের উচকরণ বাউড়ি পাড়ায় বাস সুকুমার-মহাদেবদে‌র। একসময় ৪৫ ঘর বাসিন্দার ওই পাড়াটিই এলাকার মানুষজন পালকি পাড়া হিসাবে চিনতেন। কারণ, পাড়ার প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক পুরুষ পালকি বাহকের কাজ করতেন। তাঁদের অন্যতম প্রধান জীবিকাই ছিল পালকির বাহন। সময়ের দাপটে আজ পালকি অবলুপ্ত প্রায়। কালেভদ্রে এখন পালকি বহনের ডাক আসে। জীবিকা হারিয়ে পালকি বাহকেরা আজ দিনমজুরি করছেন। কিন্তু আজও তাদের বাপ-ঠাকুরদার পেশার স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে পালকি পাড়ার খেতাব।

৬৫ বছরের কানন বাউরি বলেন, ‘‘এই সেদিনও পালকির বায়না করতে দূর-দূরান্তে মানুষজন গ্রামে ঢুকেই জিজ্ঞেস করতেন পালকি পাড়াটা কোন দিকে? এখনও এলাকার মানুষ এই পাড়াটিকেই পালকিপাড়া হিসাবেই চেনেন।’’ খেতাব রয়েছে। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে পালকি।

অথচ এমন ছিল না দিন। নানা গল্পের ভিড় শুধু। সে সব গল্পে ভর করেই পালকি আর পালকির গান বাউড়ি পাড়ায় এখন ঘোরে। স্মৃতি থেকে লক্ষণ বাউড়ি, সুকুমার বাউড়িরা বলেন, ‘‘মূলত অর্থাভাবের জন্য বাহকদের নিজস্ব কোনও পালকি ছিল না। কিন্তু বিয়ে, দ্বিরাগমন, গঙ্গা স্নান, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়া আসার জন্য বায়না তো বটেই রাত-বিরিতে ওঝা, কবিরাজ কিংবা হাসপাতাল যাওয়ার জন্য ডাক আসত আমাদের কাছে। আমরা সেইমতো পালকি মালিকেরও বায়না করতাম। গ্রামেই সে সময় ৮/১০ টি পালকি ছিল। বাইরের গ্রাম থেকেও পালকি ভাড়া আনা হত। জমিদারবাড়ির নিজস্ব পালকি বহনের জন্যও ডাক পড়ত।’’ কেমন রোজগার হত?

প্রশ্ন শুনে স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন ৭২ বছরের খুদিরাম বাউরি, ৬৫ বছরের কানন বাউরিরা। ‘‘একটি পালকি মূলত ৬ জন বাহক বা বেহারা প্রয়োজন। কিন্তু একটানা বহন থেকে কিছুটা বিশ্রাম পেতে অতিরিক্ত আরও দু’জনকে রাখা হত। আর থাকতেন একজন সর্দার। বায়না ধরা, সেই অনুযায়ী পালকি বায়না করা-সহ দলের বিবাদ-বিসংবাদ মীমাংসার গুরু দায়িত্ব পালন করতে হত সর্দারকে। দূরত্ব অনুযায়ী পারিশ্রমিক মিলত ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। কাছে পিঠে হলে একই দিনে একধিক ভাড়া খাটাও যেত। পালকি মালিককে প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য ২০/৩০ টাকা ভাড়া দিতে হত। সব মিলিয়ে দিনমজুরের সমানও আয় হত না।’’ তবুও অদ্ভূত এক ভাললাগা ছিল খুদিরাম, কাননদের।

সেই ভাললাগার টানেই এত কম আয়ের পেশার প্রতি এখনও টান! বলছিলেনও সে কথা। শুধু আয়ই নয়, এই পেশায় তেমন কোনও সম্মানও নেই। বহু ক্ষেত্রে গোয়ালঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে। খাওয়া জুটেছে সবার শেষে। কাননের কথায়, ‘‘তবু বিয়ের মরসুম এলেই মন কেমন করে। আসলে বাপ ঠাকুর্দার পেশা যেন আজও আমাদের রক্তে মিশে রয়েছে। নেশার মতো হাতছানি দেয় পালকি। এ যেন মেলায় মেলায় ঘোরা সেইসব দোকানদারদের নেশার মতো। বিক্রি বাটা কিংবা লাভ হোক বা নাই হোক মেলায় দোকান দেওয়া চাই। আর দিনান্তে পিকনিকের মেজাজে হাড়িতে চালডাল ফুটিয়ে মৌজ করে খাওয়া।’’

পালকির সেই চাহিদা আর নেই। গ্রামে গ্রামে তৈরি হয়েছে রাস্তা। পৌঁচ্ছে গিয়েছে চারচাকার গাড়িও। গ্রামের শেষতম পালকিটিও ভগ্নপ্রায়। অনভ্যাসে বর্তমান প্রজন্মের বাহকেরা ভুলতে বসেছেন তাদের নিজস্ব ঘরনার পালকির গান। সুনীল বাউরি, অশোক বাউরিরা বলেন, ‘‘ছোটবেলায় স্কুলে আমরাও পালকির গান মুখস্ত করেছি। হাল আমলের গানও শুনেছি। দুটি গানই আমাদের পুরনো দিনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের গান ছিল স্বতন্ত্র। চলার গতির ধারাবাহিকতা রক্ষার পাশাপাশি মূলত বখশিশের লোভে কর্তা-কর্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য মুখে মুখে গানও বেঁধে শ্লোগানের আদলে গাওয়া হত। সে সব আর কোথায়!’’ সে গান কেমন, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তাঁরা জানালেন, বাড়ির গিন্নিকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা গান বাঁধতেন, ‘‘কর্তাবাবুর রঙটি কালো, গিন্নি মায়ের মনটি ভাল। সামলে চলো হেঁইও।’’ আবার কর্তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময় বাইকেরা গাইতেন, ‘‘হেঁইও জোয়ান, সরু আল, চলো ধরে। কর্তাবাবুর, দরাজ দিল, দেবে ধরে।’’

এই সুর আর পালকি, দুই-ই আজ ইতিহাস। জীবিকা হারিয়ে পালকি বাহকেরা আজ দিনমজুর। সরকারি ঋণ পেলে হয়তো তাঁরা বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিতে পারতেন। কিন্তু তার নাগালও মেলেনি। নানুরের বিডিও মৃণালকান্তি বিশ্বাস বলেন, ‘‘ওইসব পালকি বাহকদের কথা জানা ছিল না। তারা লিখিতভাবে জানালে সরকারি নিয়মনীতি মেনে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE