Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

বিধি কাটতেই অনাস্থার হিড়িক

গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে তা মিটিয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু কে আর তা কানে তুলছে? নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্বের জেরে বাঁকুড়া জেলার বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতিতেও অনাস্থা আসছে। বাদ নেই পুরুলিয়াও।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০১:২৭
Share: Save:

গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে তা মিটিয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু কে আর তা কানে তুলছে? নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্বের জেরে বাঁকুড়া জেলার বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতিতেও অনাস্থা আসছে। বাদ নেই পুরুলিয়াও।

২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটের কয়েক মাসের মধ্যেই তৃণমূলের বিভিন্ন পঞ্চায়েতে দলেরই একাংশ অনাস্থা আনতে শুরু করে। তা ঠেকাতে রাজ্য সরকার আইন সংশোধন করে জানান, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আড়াই বছরের মধ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতে অনাস্থা আনা যাবে না। মাসখানেক আগে সেই সময়সীমা পার হয়েছে। বিধানসভা ভোট মিটতেই এ বার তাই অনাস্থা আনার হিড়িক পড়েছে।

এ বার সারেঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে তাঁকে পদ থেকে অপসারিত করল তাঁরই দল তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যেরা। ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর, সারেঙ্গা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান শঙ্কর সোরেনের বিরুদ্ধে দু’সপ্তাহ আগে দলেরই উপপ্রধান-সহ ১৩ জন সদস্য অনাস্থা জানিয়ে বিডিও-কে চিঠি দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার প্রধানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবের জন্য তলবিসভা ডাকা হয়। তৃণমূলের ১৮ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থার পক্ষে ভোট দেন। প্রধান-সহ তৃণমূলের ছ’জন এবং পঞ্চায়েতের একমাত্র কংগ্রেস সদস্য সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। সারেঙ্গার বিডিও অভিষেক চক্রবর্তী বলেন, “সারেঙ্গা পঞ্চায়েতের ১৯ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জনই অনাস্থার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।” তিনি জানান, পঞ্চায়েত আইন মেনে নতুন প্রধান নির্বাচন করা হবে।

দল সূত্রে খবর, প্রধান শঙ্কর সোরেন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তথা সারেঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষের অনুগামী বলে পরিচিত। এই অপসারণের পিছনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ধীরেনবাবুর বিরোধী দলের ব্লক কার্যকরী সভাপতি সুব্রত মিশ্রের অনুগামী বলে এলাকায় পরিচিত। দুই নেতার ঠান্ডা লড়াইয়ের জেরেই এই অনাস্থা বলে দলের একাংশের মত।

যদিও সারেঙ্গা পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের গোরাচাঁদ মণ্ডলের অভিযোগ, “প্রধান দীর্ঘদিন ধরেই পঞ্চায়েতে অনিয়মিত আসছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। এ ছাড়া দলের পঞ্চায়েত সদস্যদের সঙ্গে তিনি আলোচনা না করে শঙ্করবাবু একক ভাবে সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন।” ব্লক কার্যকরী সভাপতি সুব্রত মিশ্রেরও দাবি, “পঞ্চায়েত প্রধানের কাজকর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দলের সদস্যেরাই অনাস্থা এনে তাঁকে পদ থেকে সরিয়েছেন।’’ তবে তিনি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা মানতে চাননি।

যদিও শঙ্করবাবু পাল্টা দাবি করেছেন, “যে কোনও কারণেই হোক দলেরই একাংশ আমাকে সরানোর জন্য মিথ্যা অভিযোগ তুলে অনাস্থা এনেছিল।’’ তবে তৃণমূলের সারেঙ্গা ব্লক সভাপতি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে সোমবারই বাঁকুড়ার জয়পুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে তাঁরই দলের সদস্যেরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছেন। এ বার জয়পুর ব্লকের রাউৎখণ্ড পঞ্চায়েতে প্রধানের বিরুদ্ধেও অনাস্থা আনলেন দলীয় সদস্যেরাই। সোমবার বিকেলেই জয়পুরের বিডিও-র কাছে অনাস্থার চিঠিটি পাঠানো হয়। প্রসঙ্গত ১৫ আসনের ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে সব ক’টিই তৃণমূলের দখলে। পঞ্চায়েত প্রধান মহম্মদ শেখকে সরাতে চেয়ে তাঁদের মধ্যে ১৩ জন সদস্যই স্বাক্ষর করেছেন।

কারণ হিসেবে অনাস্থা আনা ওই পঞ্চায়েতের স্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ পূর্ণিমা চন্দ প্রধানের বিরুদ্ধে সারেঙ্গার মতোই বাকিদের অন্ধকারে রেখে নিজের মর্জিতে কাজ করার অভিযোগ তুলেছেন। পূর্ণিমার আরও অভিযোগ, ‘‘পঞ্চায়েত প্রধান মহম্মদ শেখ তৃণমূলের ওই অঞ্চলের সভাপতি। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে দলের প্রচারে নামতে দেখা যায়নি।’’ দলের জয়পুর ব্লক সভাপতি স্বপন কোলেরও দাবি, ‘‘প্রধান সবাইকে নিয়ে চলতে পারেন না। ফলে ওই পঞ্চায়েতের উন্নয়ণে ব্যাঘাত ঘটছে। সে কারণেই একযোগে তাঁর বিরুদ্ধে এই অনাস্থা।’’ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে মহম্মদ শেখ পাল্টা দাবি করেছেন, ‘‘যা বলা হচ্ছে সবই মিথ্যা। আমি জেলা নেতৃত্বকে সবই জানিয়েছি।’’ জয়পুরের বিডিও ধ্রুবপদ সান্ডিল্য জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তলবিসভা ডাকা হবে।

এরই মধ্যে সিপিএমও অনাস্থা এনেছিল হিড়বাঁধ পঞ্চায়েত সমিতিতে তাদের দলত্যাগী সভাপতি মোনালি মহান্তির বিরুদ্ধে। সপ্তাহখানেক আগে খাতড়ার মহকুমাশাসকের কাছে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন সিপিএমের ছয় সদস্য। মঙ্গলবার ওই অনাস্থার জন্য ব্লক অফিসে তলবিসভা ডাকা হয়। কিন্তু সিপিএমের কোনও সদস্যই এ দিন ব্লক অফিসে হাজির হননি। পঞ্চায়েত সমিতিতে থাকলেও পাশের ব্লক অফিসে হাজির হননি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি-সহ তৃণমূলের সদস্যেরা।

হিড়বাঁধের বিডিও শঙ্খশুভ্র দে জানিয়েছেন, এ জন্য অনাস্থা খারিজ হয়ে গিয়েছে। বিডিও বলেন, “অনাস্থার প্রস্তাবক-সহ কোন সদস্যই এ দিন তলবি সভায় উপস্থিত হননি। তাই পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী এই অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে হিড়বাঁধ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে আর অনাস্থা আনা যাবে না।”

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলার মধ্যে একমাত্র হিড়বাঁধ পঞ্চায়েত সমিতি দখল করেছিল সিপিএম। পঞ্চায়েত সমিতির ১৪টি আসনের মধ্যে সিপিএম পেয়েছিল ৯টি। তৃণমূল জিতেছিল ৫টি আসনে। বছরখানেক আগে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের মোনালি মহান্তি এবং আর এক সদস্যা সুচিত্রা মুদি তৃণমূলে যোগ দেন।

সিপিএমের হিড়বাঁধ জোনাল কমিটির সম্পাদক শেখ ইউনিস অবশ্য এ দিন তলবি সভায় দলের সদস্যদের অনুপস্থিতির পিছনে অন্য ব্যাখা শুনিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, “এ দিন ভোটাভুটি হবে জেনেই তৃণমূল বাইরে থেকে এলাকায় প্রচুর লোকজন জড়ো করেছিল। প্রশাসন সব জেনেও হাত গুটিয়ে বসেছিল। নিরাপত্তার কারণে তাই আমাদের সদস্যদের ব্লক অফিসে যেতে নিষেধ করা হয়।’’

তিনি জানান, তাঁদের দলের আরও এক সদস্যকে তৃণমূল নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে। অশান্তি এড়াতেই তাঁদের কেউ তাই আর ব্লক অফিসে যাননি।

অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের হিড়বাঁধ ব্লক সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ মাঝি বলেন, “সিপিএম অনাস্থা এনেছিল। এ দিন আমাদের পক্ষে ৮জন সদস্য ব্লক অফিসে হাজির ছিলেন। সিপিএমের কেউ তলবি সভায় আসেনি দেখেই আমাদের দলের কেউ আর তলবিসভায় যাননি। আমরা কাউকে ব্লক অফিসে আসতে বাধা দিইনি।”

বিডিও জানান, তলবিসভার জন্য ব্লক অফিস চত্বরে ও তার বাইরে কড়া পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের কাছে কেউ কোনও অভিযোগ জানায়নি। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির কটাক্ষ, ‘‘অনাস্থা যে ধোপে টিকবে না তা জেনেই বিরোধীরা এ দিন তলবি সভায় আসেননি।”

অন্য বিষয়গুলি:

no confidence panchayet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy