Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

হামলার ভয়ে মাঠেই কাটল রাত

বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে  পিলখুণ্ডি, সাঁকবাহা, পুন্দরা গ্রামেও। দিনভর বোমাবাজি, বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে।

প্রহরা: ফের না ছড়ায় অশান্তি। গ্রামের পথে ঘুরে সতর্ক নজরদারি নিরাপত্তাবাহিনীর। বৃহস্পতিবার নানুরের বন্দর গ্রামে। ছবি: কল্যাণ আচার্য

প্রহরা: ফের না ছড়ায় অশান্তি। গ্রামের পথে ঘুরে সতর্ক নজরদারি নিরাপত্তাবাহিনীর। বৃহস্পতিবার নানুরের বন্দর গ্রামে। ছবি: কল্যাণ আচার্য

নিজস্ব সংবাদদাতা
নানুর, বোলপুর শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৯ ০২:০০
Share: Save:

বছর দশেক আগের স্মৃতি ফিরল নানুরের সাঁকবাহা এলাকার মঞ্জুর মোল্লা, পিলখুণ্ডির এহেসান শেখদের (নাম পরিবর্তিত) মনে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সে বারও এলাকা দখলের লড়াইয়ে তেতে উঠেছিল গ্রামের পর গ্রাম। এহেসানরা তখন সবে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে ভিড়েছেন। অভিযোগ, সে জন্য তদানীন্তন শাসকদলের আক্রোশের মুখে পড়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল তাঁদের। শাসকদল আর পুলিশের ‘তাড়া’ খেয়ে রাতের পর রাত খোলামাঠে কাটাতে হয়। শেষে সিপিএমেই থাকার মুচলেকা দিয়ে গ্রামে ফেরেন। পরে ফের তৃণমূলে যোগ দেন এহেসানরা।

দল বদলে বিজেপিতে যোগ দিতেই এ বার তৃণমূলের চক্ষুশূল হয়েছেন বলে অভিযোগ এহেসানদের। ফের শুরু হয়েছে গ্রাম দখলের লড়াই। ঘরবাড়ি ছেড়ে বুধবার ফের মাঠেই কাটাতে হয়েছে রাত। এ ভাবেই টাটকা হয়েছে পুরনো স্মৃতি। কবে গ্রামে ফিরতে পারবেন তার নিশ্চয়তা পাননি। মঞ্জুরের অভিযোগ, ‘‘আগের মতোই ফের শাসকদলে না ফেরা পর্যন্ত হয়তো গ্রামে ফিরতে পারব না। ফিরলে হয় তৃণমূলের লোকেরা হামলা করবে, না হলে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেবে। অনেকেই তাই শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন। কত দিন আর বাড়ি, সংসার ফেলে মাঠে রাত কাটানো যায়?’’

এই প্রশ্ন শুধু এহেসানদেরই নয়, পুন্দরা, সাঁকবাহা, পিলখুণ্ডি, বন্দর সহ অন্য অনেক গ্রামের মানুষের। স্থানীয় সূত্রে খবর, বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরাই নন, আক্রমণের আশঙ্কায় গ্রামছাড়া রয়েছেন তৃণমূল সমর্থক পরিবারের লোকেরাও। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এক সময় ওই সব গ্রামে বিজেপির অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। তখন সিপিএমের সঙ্গে টক্কর হতো তৃণমূলের। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূলে যোগ দেন বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থকেরা। রাজনৈতিক মহলে কানাঘুষো, তাঁদের দাপটে আদি তৃণমূল কর্মীরা ‘কোণঠাসা’ হয়ে বিজেপির দিকে ঝোঁকেন। সিপিএমের অনেক কর্মী-সমর্থকও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বিজেপিকে সমর্থন জোগান। তাই গ্রামদখল ঘিরে দু’পক্ষের সংঘাত অনিবার্য ছিল। বুধবার তা-ই প্রকাশ্যে এল।

বুধবার বিজেপির পথ অবরোধ ঘিরে অশান্তি শুরু হয়। দলের এক কর্মীকে ‘বিনা দোষে’ গ্রেফতার করার অভিযোগ তুলে বন্দর বাসস্ট্যান্ডের কাছে নানুর-বাসাপাড়া সড়ক অবরোধ করেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা। পুলিশ অবরোধ তুলতে গেলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। অভিযোগ, পুলিশের লাঠির ঘায়ে এক মহিলার মাথা ফাটে। মাথা ফাটে নানুর থানার ওসিরও। প্রথম দিকে বিজেপি কর্মীরা পুলিশকে তাড়া করে গ্রামের বাইরে বের করে দিলেও পরে পিছু হঠতে শুরু করে। বিজেপির অভিযোগ, সেই সুযোগে তৃণমূলের লোকেরা গ্রামদখলের জন্যে বোমাবাজি শুরু করে। তৃণমূল অবশ্য পাল্টা বোমাবাজির অভিযোগ তোলে বিজেপির বিরুদ্ধেই।

বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে পিলখুণ্ডি, সাঁকবাহা, পুন্দরা গ্রামেও। দিনভর বোমাবাজি, বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। অভিযোগ, তৃণমূলের হামলা আর পুলিশের ধরপাকড় এড়াতে গ্রামছাড়া হন বিজেপি সমর্থক পরিবারের পুরুষেরা। তৃণমূল সমর্থক হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু পরিবারের পুরুষদেরও গ্রামে দেখা মেলেনি। বুধবার রাতেও কয়েকটি বাড়িতে ভাঙচুর এবং আগুন লাগানোর অভিযোগ ওঠে দু’পক্ষের বিরুদ্ধে। সাঁকবাহা গ্রামের তৃণমূল সমর্থক আদরী বিবি বলেন, ‘‘বিজেপির লোকেরা চড়াও হতে পারে বলে আমাদের পরিবারের পুরুষেরা গত রাতে বাড়িতে ছিল না। খুব আতঙ্কে রয়েছি।’’

আতঙ্কের ছাপ বন্দর দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দাদের চোখেমুখেও। স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই পাড়ার ১২৫টি পরিবারের মধ্যে ১২০টিই বিজেপি সমথর্ক। মাত্র পাঁচটি পরিবার তৃণমূল সমর্থক। এ দিন ওই পাড়ায় কোনও পুরুষের দেখা মেলেনি। চারদিক থমথমে। মহিলারা মুখ খুলতে নারাজ। গ্রামে পুলিশ টহল দিচ্ছে। তবুও আতংকের ছাপ গ্রামবাসীদের চোখে মুখে৷

লোকসভা ভোটের দিনও তৃণমূল-বিজেপি সংঘর্ষে তেতে উঠেছিল ওই গ্রাম। বিজেপি সমর্থকদের ভোটদানে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এক বৃদ্ধ সহ তিন জনের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর এবং কর্মীদের জন্য রান্না করা খাবার নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিজেপি সমর্থক এক পরিবারের মহিলা বলেন, ‘‘ভোটের দিন থেকেই ওরা ফু্ঁসছিল। এখন পুলিশকে সামনে রেখে গ্রামদখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে।’’

বিজেপির নানুর মণ্ডল কমিটির সভাপতি বিনয় ঘোষ বলেন, ‘‘পুলিশ আমাদের দলের কর্মী-সমর্থকদের তাড়িয়ে তৃণমূলকে গ্রামদখলের সুযোগ করে দিচ্ছে। আমাদের লোকেরা যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পারে, সে জন্য তৃণমূলের লোকেরা মুখে গামছা বেঁধে বিভিন্ন জায়গায় বাস থামিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে।’’

অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের নানুর ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পুলিশের উপরে হামলা চালিয়ে গ্রেফতারের ভয়েই ওরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আর আমাদের নামে মিথ্যা অভিযোগ করেছে।’’

পুলিশ জানায়, ওই ঘটনায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ২০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে ৪ মহিলা সহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের ধরার চেষ্টা চলছে৷ উত্তেজনা থাকায় এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে খবর, ধৃতদের বেশিরভাগই বিজেপি সমর্থক। বৃহস্পতিবার তাঁদের বোলপুর মহকুমা আদালতে তোলা হলে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক অরবিন্দ মিশ্র ১৪ দিন জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন। ধৃতদের বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধর, সরকারি কাজে বাধা, হুমকি, অবৈধ জমায়েত সহ একাধিক ধারায় মামলা রজু করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সরকারি আইনজীবী ফিরোজকুমার পাল জানান, পুলিশ নিজেদের হেফাজতে চেয়ে আবেদন জানায়নি। বিচারক ধৃতদের ১৪ দিনের জেল হেফাজতে পাঠান।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy