শ্রদ্ধা: কলাভবনে পুরনো নন্দন বাড়ির আচার্যের স্টুডিয়োতে নন্দলাল বসুকে জন্মদিন উদযাপন। নিজস্ব চিত্র
শতবর্ষ ছোঁয়া কলাভবনের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই একান্তে প্রশ্ন করি, নন্দলালকে বাদ দিয়ে এই শিল্প-নিকেতনের প্রাণপ্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব ছিল? এর স্পষ্ট উত্তর হবে না। কেননা, সেটা কখনও হতে পারত না। রবীন্দ্রনাথের কলাভবনের জন্য নন্দলালই ছিলেন যোগ্যতম ব্যক্তি। শিল্পী ও শিক্ষক উভয় ক্ষেত্রেই।
এই সত্যটি জেনে রবীন্দ্রনাথ গোড়াতেই নন্দলালের জন্য গুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছে দরবার করেছিলেন। প্রথমে সফল না হয়ে প্রিয় ভাইপোর উপরে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও পিছপা হননি। কিন্তু, সেই পর্বে নন্দলালকে কতটা চিনেছিলেন তিনি? ‘চয়নিকা’র ছবির সূত্রে কিছু চেনাশোনা হয়েছিল বটে। কিন্তু, তাকে তেমন গভীর আলাপ বলা চলে না। ছবি আঁকার সুবিধার জন্য সেবার নন্দলালকে কয়েকটা কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন মাত্র। তবু তাঁর দূরদৃষ্টির কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। অবনের অন্য শিষ্যদের মাঝে এই মুখচোরা শ্যামলা ছেলেটির মধ্যে এমন কী দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
ঠাকুরবাড়ির আর এক তরুণ শিল্পী অসিত হালদার তাঁর নাগালেই ছিলেন। তবুও কেন শুধু নন্দলালের উপরেই এতটা নির্ভরতা? এমনকি ‘চয়নিকা’ পর্বের অব্যবহিত পরে নন্দলালের একটি আঁকা ছবি ‘দীক্ষা’ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে একটি গান রচনায়। সেই অসাধারণ গান ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা’ আর নন্দলালের ছবি একই সঙ্গে ছাপা হল ‘ভারতী’র পাতায়। কোনও আঁকিয়ের পক্ষে এমন সম্মান প্রথম, যাঁর ছবি রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে অসাধারণ গান। যদিও সেই গান চিত্রীর ছবিকে ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে অন্য মাত্রায়। তার পরেও আমাদের মনে হয় কবি ও শিল্পীর অন্তরের আলাপন বুঝি শুরু হয়েছে এখান থেকেই।
মনে হয়, কলাভবনের দায়িত্ব দেওয়ার আগে নন্দলালকে ধীরে ধীরে তৈরি করে নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আজ যাকে বলি ‘গ্রুমিং’। তাই তাঁর হাতে তৈরি হয়েছেন রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী প্রমুখের মতো স্রষ্টা। এ কি সহজ কথা! শুধু কলাভবনের নির্মাণ নয়। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীও নন্দলালের উপরে নির্ভর করতেন। খেয়াল করলে দেখি, নন্দলালের শিল্পী সত্তাকে যদি জ্যামিতিক বিন্যাসে একটি চতুর্ভুজের আকারে চিহ্নিত করতে হয়, তা হলে তার প্রথম বাহুটি অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষা, দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ, তৃতীয়টি গাঁধীর ভাবধারা এবং শেষেরটি রামকৃষ্ণ মিশনের আধ্যাত্মিকতায় অবগাহিত।
শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রী, বীরভূমের প্রকৃতি, আদিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পরিণত করেছিল আর এক নন্দলালে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে গুরু অবনীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর আচার্য হলে গুরুর শিক্ষাদর্শের সঙ্গে কখনও মতের অমিল হলেও শিষ্য নিজের আদর্শে অটল থেকেছেন। আজ তাঁর জন্মদিনে কলাভবনের শতবর্ষে দাড়িয়ে এই মানুষটির কাছে নতজানু হই।
অবসরপ্রাপ্ত অবেক্ষক, কলাভবন সংগ্রহশালা, শান্তিনিকেতন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy