খুদের আবদার মেটাতে নিজস্বী। ঝালদায় ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।
জনপ্রিয়তায় নেতার চেয়ে অভিনেতা যে কয়েক কদম এগিয়ে থাকেন, সে কথা মুকুল রায়ের মত ঝানু রাজনীতিবিদের অজানা নয়। সেই জনপ্রিয়তাকে রাজনীতির ময়দানে কেমন করে কাজে লাগাতে হয় সেটাও বিলক্ষণ জানেন তিনি। করলেনও তা-ই। শুক্রবার বান্দোয়ান এবং পুরুলিয়ার দু’টি জনসভায় তাঁর সঙ্গী অভিনেতা সাংসদ দেবের জনপ্রিয়তাকে পুরোদস্তুর কাজে লাগালেন তিনি।
এ দিন দুপুরে দেব এবং মুকুলের প্রথম সভাটি ছিল বান্দোয়ানের ডব্লুডি মাঠে, ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রাজীব সরেনের সমর্থনে। বেলা ১১টা থেকেই নায়ককে সামনে থেকে দেখার জন্য মাঠে জড়ো হতে শুরু করেছিলেন মাগলা গ্রামের শীতল মাঝি, অপর্ণা মাঝি, সন্তোষ মাঝিদের মত অনেকে। দুপুর ১টা ৪০ নাগাদ মাথার উপরে শোনা গেল কপ্টারের আওয়াজ। নেতার আগে কপ্টার থেকে নামলেন অভিনেতা। সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জনতার দিকে হাত নাড়তে হল। তারপর মঞ্চের দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন দেব। মুকুল রায় তখন বেশ কিছুটা পিছনে। দেবকে এগিয়ে দিয়ে তিনি নিজে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোলেন ধীরেসুস্থে।
এ দিন মুকুলবাবু প্রায় ১২ মিনিট বক্তৃতা দেন। উঠে আসে বান্দোয়ানের নাশকতার প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল সরকারে আসার পর বান্দোয়ানের পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে। জনজীবন স্বাভাবিক হয়েছে। আমরা ২০১১ সালে বান্দোয়ান পাইনি। আশা করছি বান্দোয়ানের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ বার আপনারা আমাদের পাশে থাকবেন।’’ প্রার্থী রাজীবের প্রসঙ্গে তিনি ফের জোটকে নিশানা করেন। বান্দোয়ান কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রাজীব সরেনের বাবা জাগরণ সোরেন ছিলেন কংগ্রেস কর্মী। তাঁকে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল সিপিএমের বিরুদ্ধে। মুকুলবাবু এ দিন বলেন, ‘‘যে সিপিএম রাজীবের বাবাকে খুন করেছে, তারাই এখন কংগ্রেসের হাত ধরেছে।’’
কিন্তু রাজনীতির কচকচির চেয়ে জমায়েতে থাকা মানুষ জনের উৎসাহ যে দেবকে কেন্দ্র করেই, তা জেনে এর পরেই সেই তাসটিই খেলেন তিনি। বলেন, ‘‘যাঁর জন্য প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে আপনারা দীর্ঘক্ষণ বসে রয়েছেন, সেই দেব এ বার বলবেন।’’ ভিড়ের মধ্যে হইহই শুরু হয়ে গেল।
মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে দেব বলেন, ‘‘আমি ভোটের জন্য রাজনীতি করি না। আমি দিদিকে শ্রদ্ধা করি। মনে করি, দিদির হাত ধরেই বাংলার উন্নয়ন সম্ভব। আমার সব থেকে বড় পাওয়া আপনারা।’’ মাঠ জুড়ে শুরু হল হাততালি। তারপর রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের বিভিন্ন ফিরিস্তি দিলেন অভিনেতা সাংসদ। ভোটের আগে নেতাদের মুখে যে সমস্ত কথা শুনে প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছে সবার, অভিনেতার মুখে সেই কথাগুলি শুনেও হাততালির রোল উঠল। দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করে মিনিট সাতেকের বক্তৃতা শেষ করেন দেব। সেই ছোট্ট বক্তৃতা আর উপস্থিতি দিয়ে ভোটের রাজনীতির অনেক কাজ হাসিল করিয়ে অভিনেতাকে নিয়ে মুকুল রায়ের কপ্টার উড়ল ঝালদার দিকে।
ঝালদার সভায় জমায়েত হয়েছিল প্রায় হাজার চারেক মানুষের। সেখান থেকে মুকুল এবং দেব পৌঁছন পুরুলিয়া-বাঁকুড়া ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে হুটমুড়া স্কুলের মাঠে। মাঠ থইথই করছিল ভিড়ে। অধিক উৎসাহীরা আগে থেকে এসে মঞ্চের সামনের জায়গা দখল করে বসেছিলেন। মঞ্চে প্রার্থী দিব্যজ্যোতি প্রসাদ সিংহ দেওয়ের সমর্থনে বক্তৃতা দিচ্ছেন স্থানীয় নেতারা। কিন্তু হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে ঘন ঘন সবাই তাকাচ্ছেন আকাশের দিকে— ওই বুঝি দেখা গেল কপ্টার! ঘড়ির কাঁটা ৩টের ঘর ছোঁয়ার আগেই কপ্টারের শব্দ কানে এল। তখন কে শোনে কার কথা! কপ্টার মাটি ছোঁয়ার আগেই বসার জায়গা ছেড়ে অনেকে ছুটতে শুরু করলেন সে দিকে। তাদের একটা বড় অংশ কিশোর-কিশোরী। ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া কুশল বাউরি, রিয়া বাউরি, দ্বিতীয় শ্রেণির তুফান বাউরি, প্রথম শ্রেণির শুভরাজ বাউরিরা নিজেরা ভোটার নয়, নায়ককে দেখতে এসেছে শুধু। মাইকে নেতাদের বক্তৃতায় এক কিশোরের কানে আসেনি কপ্টারের আওয়াজ। পাশের জন তাকে ঠেলা মেলে বলে ওঠে, ‘‘চল চল, দেব এসে গিয়েছে।’’ মহিলা পুলিশকর্মীদের ব্যারিকেডের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল জামবাদ গ্রামের বাসিন্দা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সোমা মাহাতো, একাদশ শ্রেণির ছাত্রী হুড়ার শুভশ্রী রেজা এবং তার দিদি অর্পিতা মুর্মু। এক মুখ হাসি নিয়ে সোমা, অর্পিতা এবং শুভশ্রী বলে, ‘‘দেবকে সামনে থেকে দেখার জন্য সেই দুপুর থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’’
ধুলোর ঝড় তুলে কপ্টার নামল মাটিতে। কপ্টার থেকে নেমে প্রায় পাঁচশো মিটার হেঁটে মঞ্চে উঠলেন মুকুল রায় এবং দেব। নায়কের নামে তখন হর্ষধ্বনি শুরু করেছে জনতা। দীর্ঘক্ষণ জায়গা আঁকড়ে বসে থাকা লোকজনও হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন মোবাইল হাতে। বাদ পড়লেন না মঞ্চের সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা পুলিশ কর্মীও। ভক্তদের ক্যামেরাবন্দি হলেন নায়ক। নাতি নাতনিদের নিয়ে লুকুইডি গ্রামের শান্ত মাহাতোর মত অনেক বয়স্ক মানুষও এসেছিলেন। হট্টগোলের মধ্যেই তাঁদেরই এক জনকে পাশের জনকে বলতে শোনা গেল, ‘‘এত ছোটাছুটি করছে, দাড়িটাও কাটার সময় পায়নি।’’
মুকুল রায় কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, দু’টাকা কেজি চাল-সহ নানা কাজের ফিরিস্তি দেন তাঁর বক্তৃতায়। যখন দেবের হাতে মাইক তুলে দিলেন মুকুল, হাততালিতে ফেটে পড়ল মাঠ। রাজনৈতিক দলের জনসভার বদলে অনুষ্ঠানের মেজাজে জনতাকে উদ্দেশ করে বক্তৃতা শুরু করলেন দেব। টেনে আনলেন কলকাতার ফ্লাইওভার দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ। দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে দাবি করে সিপিএমের যুবসংগঠনের রক্তদান শিবির বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের এক চিকিৎসক বিধায়কের বিরুদ্ধে। এ দিনের জনসভায় দেব বলেন, ‘‘ঘটনাটি নিয়ে অনেকে রাজনীতি করছেন। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। মানুষের জন্য রাজনীতি, রাজনীতির জন্য তো মানুষ নয়।’’ তারপর সরাসরি ভোটের প্রসঙ্গে চলে এসে বলেন, ‘‘জোর করে তো ভোট চাওয়া তো যায় না। কিন্তু যাঁকে সব সময় পাশে পাওয়া যায় তাঁকেই ভোটটা দিতে হয়। যেমন আমার ভোট চোখ বন্ধ করে দিদিকে দিই আমি।’’
তারপরে এল উন্নয়নের প্রসঙ্গ। ভিড়ের মধ্যে থাকা কিশোরীদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘‘দিদি সকলের জন্য কন্যাশ্রী দিয়েছে। সত্যি না মিথ্যে?’’ নায়কের প্রশ্নের উত্তরে মুগ্ধ জনতাকিশোর-কিশোরীরা জানাল, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল, রাস্তাঘাট—সব সত্যি। আকাশে তখন অল্প মেঘ। কপ্টার উড়েছে আকাশে। দেবের ভক্ত এক কিশোর সে দিকে তাকিয়ে দৌড়চ্ছিল। আকাশের দিকে ক্যামেরা তাক করে দৌড়চ্ছিলেন এক চিত্র সাংবাদিকও। ধাক্কা খেয়ে দু’জনেই পড়ে গেলেন মাটিতে। দু’জনে উঠে যখন জামার ধুলো ঝাড়ছেন, অভিনেতাকে নিয়ে নেতার কপ্টার চলে গিয়েছে চোখের আড়ালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy