বিষ্ণুপুরের পরে এ বার আক্রান্ত হলেন বড়জোড়ার বিধায়ক।
সোমবার বিকেলে বড়জোড়ার পখন্যায় সিপিএমের বিধায়ক সুজিত চক্রবর্তীর গাড়ি আটকে ভাঙচুরের অভিযোগ উঠল তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে। সেই সময় ওই গাড়িতে ছিলেন সুজিতবাবু এবং সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী। তাঁরা কোনও রকমে হামলাকারীদের এড়িয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসায় রক্ষা পেয়েছেন। কিছুদিন আগেও বড়জোড়ার বিধায়কের গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। সেই ঘটনায় অবশ্য দু’জন তৃণমূল কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
রবিবার রাতে বড়জোড়ারই তাজপুর এলাকার এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে হামলা হয় বলে অভিযোগ। সারেঙ্গাতেও সিপিএমের এক শিক্ষক নেতাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। বস্তুত বাঁকুড়া জেলায় এ বার বিধানসভা ভোটে ১২টির মধ্যেই পাঁচটি কেন্দ্রেই বিরোধী জোটের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। তাই শাসকদলের কর্মীরা এই পরাজয় মেনে নিতে না পেরেই হামলা চালাচ্ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। এতগুলি হামলার পরেই পুলিশের কাছে তাঁরা আরও সক্রিয়তা দাবি করছেন। তা না হলে ভবিষ্যতে বিরোধীদের উপরে হামলা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিরোধী সিপিএম ও কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘বিধানসভার প্রথম অধিবেশনের আগেই বিষ্ণুপুর ও বড়জোড়ায় দুই বিধায়ক আক্রান্ত হলেন। গণতন্ত্রের তৃণমূল মডেল রোজই সামনে আসছে!’’
বড়জোড়ার পখন্ন্যা এলাকায় দলের পার্টি অফিস থেকে ফিরছিলেন সুজিতবাবুরা। পখন্ন্যামোড়ে দুই মহিলা রাস্তা আটকে তাঁদের গাড়ি আটকে গালিগালাজ শুরু করে বলে অভিযোগ। বিধায়ক জানান, নিমেষের মধ্যেই সেখানে তৃণমূলের বেশ কিছু কর্মী রড় ও লাঠি নিয়ে জড়ো হয়ে যান। তাঁর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূলের হামলাকারীরা আমাদের গাড়িতে দমাদম লাঠি, রড়ের ঘা মারতে থাকে। গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়। দাঁড়িয়ে থাকলে ওরা খুন করে ফেলবে বুঝতে পেরে চালককে দ্রুত ওদের পাশ কাটিয়ে গাড়ি বের করে নিয়ে যেতে বলি। নেহাতই কপাল জোরে বেঁচে গিয়েছি।’’
এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সিপিএমের কর্মীরা বড়জোড়ায় জড়ো হয়ে যান। তাঁদের নিয়ে বিধায়ক বড়জোড়া চৌমাথায় গাড়ি নিয়ে এসে পথ অবরোধ শুরু করেন। বাঁকুড়া-দুর্গাপুর ও দুর্লভপুরগামী রাস্তা আটকে দেওয়া হয়। যানজটে আটকে পরে যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হন। ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশের আশ্বাসে অবরোধ ওঠে।
শুধু বিধায়কই নয়, বড়জোড়ায় সিপিএমের নিচুতলার কর্মীদের উপরেও শাসকদলের কর্মীরা হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ। সিপিএমের অভিযোগ, রবিবার রাতে বড়জোড়ার তাজপুরে তাদের দলের কর্মী বরেন বাগদির বাড়িতে হামলা চালায় তৃণমূলের কর্মীরা। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরীর অভিযোগ, রাত প্রায় সাড়ে ১০টা নাগাদ জনা আটেক তৃণমূল কর্মী রড, লাঠি নিয়ে বরেনবাবুর বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায়। বরেনবাবুর মাথায় রডের ঘা মারে তারা। মারধর করা হয় বরেনবাবুর মা মীরাদেবীকেও।’’ ঘটনার পরেই দলের তরফে ফোন করে বড়জোড়া পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়। পুলিশ গিয়ে আহত বরেনবাবুকে উদ্ধার করে বড়জোড়া ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে বাঁকুড়া মেডিক্যালে পাঠায়। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাটি নিয়ে বরেনবাবুর পরিবারের তরফে থানায় লিখিত অভিযোগ জানানো হয়নি। সুজয়বাবু জানান, চিকিৎসা করানো নিয়ে তাঁর পরিবার ব্যস্ত থাকায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেননি। শীঘ্রই তাঁরা লিখিত অভিযোগ করবেন। এই এলাকার সিপিএম ও কংগ্রেস কর্মীদের অভিযোগ, ভোটের ফল প্রকােশর পর থেকেই বড়জোড়ায় বিরোধীদের উপর নানা ভাবে হামলা চালাচ্ছে শাসকদলের কর্মীরা। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশের ভূমিকা ভাল নয়। তৃণমূলের বড়জোড়া ব্লক সভাপতি জহর বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পুলিশের আশ্বাস, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ দিকে, সারেঙ্গা থানার গোয়ালডাঙা গ্রামের বাসিন্দা সিপিএমের সুকাডালি লোকাল কমিটির সদস্য চিত্তরঞ্জন হাজরা শুক্রবার পুলিশের কাছে কয়েক জন তৃণমূল কর্মীর নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। চিত্তরঞ্জনবাবু খাতড়া হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক। কয়েক মাস আগে গ্রামের একটি গ্রন্থাগার পরিচালন সমিতির সদস্য প্রতিনিধি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিপিএমের এই শিক্ষক নেতাকে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের স্থানীয় কয়েক জনের বিরুদ্ধে। ফেব্রুয়ারি মাসে ওই সিপিএম নেতার বাড়ির সামনের ফুল ও গাছের বাগান ভেঙে নষ্ট করার অভিযোগ ওঠে। তখনও অভিযোগের তির ছিল তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে।
চিত্তরঞ্জনবাবুর অভিযোগ, “সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে আমি দলের প্রার্থীর হয়ে প্রচার চালিয়েছিলাম। সেই আক্রোশে তৃণমূলের লোকেরা আমাকে ভোটের আগে থেকেই দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। এখন গ্রামে আমাকে কার্যত একঘরে করে রেখেছে। গ্রামের কোন মানুষকেই আমার সঙ্গে মেলামেশা করতেও দিচ্ছে না তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। ওদের হুমকিতে আমাকে বাড়ির মধ্যে গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে।” তিনি জানান, তাঁর দুই ছেলে বাইরে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে শুধু তিনি ও তাঁর স্ত্রী রয়েছেন। বাড়ির পরিচারিকাকে কাজ করতে আসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দু’দিন আগে তাঁর বাড়ির দরজায় কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ।
সিপিএমের সারেঙ্গা জোনাল সম্পাদক নিমাই মাহাতোর অভিযোগ, “এলাকায় অশান্তি সৃষ্টির জন্যই তৃণমূলের লোকেরা চিত্তবাবুকে নানা ভাবে হেনস্থা করছেন। তাঁকে গ্রামছাড়া করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।’’ রবিবার দুপুরে সিপিএমের শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ-র এক প্রতিনিধি দল ওই গ্রামে গিয়ে চিত্তবাবুর সঙ্গে দেখা করেন। সোমবার সারেঙ্গা থানায় সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্ব ঘটনার প্রতিবাদে স্মারকলিপি দেন।
অভিযোগের তির যাঁর দিকে সেই তৃণমূল নেতা মানিক সাঁই অবশ্য দাবি করেছেন, “গ্রামে চিত্ত হাজরা এখন ব্রাত্য। ওর সম্পর্কে আমি আর কোন মন্তব্য করতে চাই না।’’ তবে তৃণমূলের সারেঙ্গা ব্লক সভাপতি তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “চিত্তবাবু গ্রামের মানুষকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অতিষ্ঠ করে রেখেছিলেন। ভোটের পর তিনি নিজেই ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এখন ফিরে এসে চাইছেন। বাড়ির সামনে সবসময় পুলিশ পিকেট যাতে বসে সে জন্য সাজানো নাটক করে নজর টানতে চাইছেন।’’ জেলা পুলিশের এক আধিকারিক দাবি করেছেন, অভিযোগের পরেই ওই গ্রামে গিয়ে তদন্ত করে দেখা হয়েছে। অধিকাংশ অভিযোগের কোনও সারবত্তা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy