চেক দিচ্ছেন অশোকবাবু।—নিজস্ব চিত্র।
মাঝে মধ্যে বই কেনার টাকা মেলে। কিন্তু মেলে না বই রাখার আলমারি কেনার টাকা। মেলে না বই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও সরকারি অনুদানও। এর ফলে বাঁধাই অভাবে হাত ঘুরতে ঘুরেতে অল্প দিনেই বিপন্ন হয়ে পড়ে মূল্যবান বইয়ের অস্তিত্ব। আবার কীটনাশকের অভাবেও নষ্ট হয়ে যায় বহু বই। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে কাছ থেকেই এ সব দেখেছেন। আর যতটা পেরেছেন জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতির সামাল দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অবর্তমানে যাতে কোনও বই নষ্ট না হয়ে যায়, তার জন্য অবসরের আগেই স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে এক লক্ষ টাকার চেক তুলে দিলেন আমোদপুর জয়দুর্গা হাইস্কুলের গ্রন্থাগারিক অশোককুমার প্রামাণিক।
স্কুল ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ১৯৮৪ সালে ওই স্কুলে গ্রন্থাগারিক হিসাবে যোগ দেন অশোকবাবু। স্থানীয় কুচুইঘাটা গ্রামে স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। স্ত্রী অঞ্জনাদেবী আইসিডিএস কর্মী। মেয়ে রাজলীনা সোদপুরে ফুড টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেন। সোমবার ছিল তাঁর অবসর গ্রহণের দিন। তাঁর আগে গত বুধবার প্রধান শিক্ষকের হাতে তিনি তুলে দেন ১ লক্ষ টাকার চেক।
অশোকবাবুর এই সহযোগিতা অনুপ্রাণিত করেছে অন্যদেরও। স্কুলের শিক্ষক প্রসেনজিৎ মুখোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ মণ্ডল, সোমনাথ সরকার এবং বাসুদেব ঘোষরা বলছেন, ‘‘অশোকবাবু আমাদের পথ দেখিয়ে গেলেন। যে স্কুল থেকে আমরা জীবিকা অর্জনের সুযোগ পেয়েছি, সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য আমাদেরও যে কিছুটা দায়বদ্ধতা থাকে— তা উনিই করে দেখিয়ে দিলেন। অবসর নেওয়ার সময় আমরাও স্কুলের উন্নয়নে যথাসাধ্য সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
কী বলছেন অশোকবাবুর স্ত্রী? অঞ্জনাদেবী জানান, ওই সিদ্ধান্তের কথা শুনে প্রথম দিকে তিনি মেয়ের পড়াশোনা, বিয়ের কথা ভেবে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন। ‘‘কিন্তু উনি সাফ জানিয়ে দেন, ‘মেয়ের বিয়ের আড়ম্বর কিছুটা কম হলে লোকনিন্দা হবে হয়তো। কিন্তু সেই টাকাটায় লাইব্রেরিটা যে ভাল থাকবে’। ওই কথা শোনার পরে আমিও আর সমর্থন না জানিয়ে পারিনি,’’— বলছেন অঞ্জনাদেবী। অন্য দিকে অশোকবাবু জানান, কালেভদ্রে বই কেনার টাকা মিললেও কোনও দিন লাইব্রেরির আসবাবপত্র বা রক্ষণাবেক্ষণের কোনও অনুদান মেলে না। ছাত্রছাত্রীদের থেকে ফি বাবদ নেওয়া সামান্য কিছু টাকাই সম্বল। অন্যান্য ফি বাড়লেও তাঁর সুদীর্ঘ ৩৩ বছরের চাকরি জীবনে লাইব্রেরি ফি বাড়েনি। চোখের সামনেই তিনি সামান্য কিছু টাকার জন্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বহু মূল্যবান বই নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পুরনো কাগজ বিক্রি করে কিংবা চাঁদা তুলে আমি যতটুকু পেরেছি, পরিস্থিতির সামাল দিয়েছি। আমার অবর্তমানে যাতে সেই সমস্যা না হয়, তার জন্যই টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’’
প্রধান শিক্ষক সুশান্ত ভট্টাচার্য এবং পরিচালন সমিতির সভাপতি বাণীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অশোকবাবুর দান শুধু লাইব্রেরিরই নয়, স্কুলের অন্যান্য উন্নয়নের পথও খুলে দিয়েছে। অন্যান্য শিক্ষকরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁদের অবসরের সময় একই ভাবে দানের কথা ঘোষণা করেছেন।’’ অশোকবাবুর টাকাটা ব্যাঙ্কে থাকবে। সুদের টাকা থেকে বই কেনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy