(বাঁ দিকে) অনুব্রত মণ্ডল। কাজল শেখ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
তিহাড় জেল থেকে অনুব্রত মণ্ডল ফেরা ইস্তক বীরভূমে তৃণমূলের অন্দরে শুরু হয়েছে চাপানউতর। ইঙ্গিত মিলেছে অনুব্রত এবং কাজল শেখের দ্বন্দ্বেরও। জেলা তৃণমূলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের নানা জল্পনার মাঝেই শনিবার মুখোমুখি হলেন কেষ্ট-কাজল। তা-ও আবার বোলপুরের তৃণমূল কার্যালয়ে! যা নতুন করে সেজে উঠেছিল কেষ্ট বাড়ি ফেরার পরেই। অন্য নেতাদের ছবি সরিয়ে এই কার্যালয়ের ঘরে জায়গা পেয়েছে কেবল কেষ্টরই ছবি। প্রকাশ্যেই ওই কাজের সমালোচনা করতে শোনা গিয়েছে কাজলকে। তবে শনিবার বিকেলে সেই কার্যালয়েই ‘দাদা’র সঙ্গে দেখা করতে গেলেন বীরভূমের জেলা সভাধিপতি কাজল।
আধ ঘণ্টার বৈঠকের পর দু’জনের মুখেই হাসি। দুঁদে দুই নেতার ঘনিষ্ঠেরা জানিয়েছেন, বৈঠকে নাকি কোনও রাজনৈতিক কথাই হয়নি! তাঁদের দাবি, ‘কেষ্টদা’র শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ‘কাজলদা’। আর ‘কেষ্টদা’ বলেছেন, এ বার কালীপুজোটা ভাল করে করতে হবে। বার্তা দিয়েছেন সকলকে নিয়ে একসঙ্গে চলার। তবে শনিবারের বৈঠকের পর কাজল বলেন, ‘‘দাদার (অনুব্রত) শরীর খারাপ। আগামিকাল হয়তো তিনি কলকাতায় যাবেন।’’ আর রাজনৈতিক আলোচনা? কাজলের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘অনুব্রত আমাদের সভাপতি পদে রয়েছেন। আগামী দিনে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে দেখা যাবে। খুব শীঘ্রই কোর কমিটির বৈঠক ডাকা হবে। যেখানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অনুব্রত মণ্ডল।’’
কাজল তার পর চলে যান কেষ্টর উদ্যোগে কালীপুজো প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘এক সময় তিনি যখন ছিলেন না (বীরভূমে), তাঁর কালীপুজো আমি দায়িত্ব নিয়ে করেছিলাম। আগামী দিনেও আমাকে বলা হলে আমি নিশ্চয়ই পাশে থাকব।’’
গরু পাচার মামলায় জামিন পেয়ে জেলায় ফেরার পর তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা অনুব্রতের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। যাননি কেবল কাজল। তার পর বীরভূমের বিভিন্ন জায়গায় ‘এলাকার দখল’ নিয়েছেন কেষ্টর অনুগামীরাও। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন নানুরের নেতা তথা অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ কেরিম খানও। এই প্রেক্ষিতে বুধবার দলীয় বৈঠকে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা যায় বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা তৃণমূলের কোর কমিটির সদস্য কাজলকে। তিনি বলেন, ‘‘আমি পঞ্চায়েতের পার্সেন্টেজ খেতে আসিনি। আমি নদীর বালি তুলে খেতে আসিনি। লোকের জায়গা জোর করে দখল করতে আসিনি। যদি বাঁকা পথে চলো, সোজা পথে আনার রাস্তা আমাদের জানা আছে। পাঙ্গা নিতে এসো না, আমি চুড়ি পরে বসে নেই।’’ কাজল এ-ও বলেছিলেন, ‘‘অনেক ঘাটের জল এই পেটে আছে। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমি সব খেলা খেলতে জানি। দাবা খেলাও খেলতে জানি, হাডুডুও খেলতে জানি। ‘খেলা হবে’ গান শুনিয়ে লাভ হবে না বন্ধু।’’
বস্তুত, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের সময় থেকে অনুব্রতের লব্জে বার বার শোনা গিয়েছে ‘খেলা হবে’ হুঁশিয়ারি। কাজলের মন্তব্য কি কেষ্ট এবং কেষ্ট-অনুগামীদের উদ্দেশ্যেই? বীরভূম তৃণমূল নেতৃত্ব গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি। আবার নিজের মন্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনুব্রতকে নিজের অভিভাবক বলে উল্লেখ করেন কাজল। তার মধ্যে দুই নেতার বৈঠক ঘিরে জল্পনা শুরু হয় জেলা রাজনীতিতে।
আসলে কাজল এবং অনুব্রতের ‘সুসম্পর্ক’ সুবিদিত। অনুব্রত বীরভূমে তৃণমূল জেলা সভাপতি থাকাকালীন কাজলকে দলে ‘কোণঠাসা’ হয়ে থাকতে হয়েছিল। দুই পক্ষের অন্তর্বিরোধও বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। সেই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কাজলের অন্তর্ঘাতের জন্যেই নানুরে জেতা আসনে সিপিএমের কাছে অনুব্রতের ‘স্নেহধন্য’ গদাধর হাজরাকে হারতে হয় বলে তৃণমূলের অনেকের দাবি। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নানুর এলাকায় কাজলকে ভোটের দায়িত্ব দেন অনুব্রতই। কাজল ওই নির্বাচনে বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের আওতাধীন ৭টি বিধানসভার মধ্যে নানুরে দলকে সর্বোচ্চ লিড-ও দেন। তার পরে কাজল ব্লক কার্যকরী সভাপতির পদ পান। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে নানুর ‘পুনরুদ্ধার’ করে কাজল আবার তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করেন। তার পর গরু পাচার মামলায় অনুব্রত জেলে যাওয়ার পরে দলে কাজলের গুরুত্ব বাড়ে। তাঁর অনুগামীরাও সক্রিয় হয়ে ওঠেন জেলার রাজনীতিতে।
বীরভূমে জেলা সফরে এসে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাজলকে জেলা কোর কমিটির সদস্য করে দিয়ে যান। নানুর এলাকা থেকে প্রথম নির্বাচনে জিতে জেলা সভাধিপতি মনোনীতও হন তিনি। দলনেত্রী মমতা গত লোকসভা নির্বাচনে কাজলকে নানুর এবং কেতুগ্রাম বিধানসভা এলাকা দেখার দায়িত্ব দেন। তৃণমূল সূত্রে দাবি, সেই থেকে ওই দু’টি কেন্দ্র বিশেষ করে নানুরে রেকর্ড সংখ্যক লিড দেওয়াটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাজলের কাছে। সেটা তিনি করেও দেখিয়েছেন। কিন্তু মঙ্গলবার নেতা-মন্ত্রীরা কেষ্টর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে গেলেও সেই চৌহদ্দিতে দেখা যায়নি কাজলকে। তিনি দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফর ছিল। তাই সময় বার করতে পারেননি। কাজল কারণ দেখান, ‘‘বীরভূমের ন’টি অঞ্চল বন্যাবিধ্বস্ত। জেলার সভাধিপতি হিসাবে আমার দায়িত্ব আছে। মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্ট নিতে এসেছিলেন। আর দাদার বাড়ি ভাই যাবে, তাতে দিনক্ষণ, সময় জানানোর কী আছে!’’ শনিবার ‘দাদা-ভাই’য়ের দেখা হল। কিন্তু আর কী কথা হল? কাজল এ বার যেন সাবধানি। জানালেন বাকিটা ব্যক্তিগত। শনিবার শুধু সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল। রাজনৈতিক আলোচনা পরে করবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy