পুরপ্রধানের কুর্সি নিয়ে যেন মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা হয়েছে। তাই ২০১৫ সালের পুরভোটে যারাই ক্ষমতায় আসুক আর যেন ওই খেলা না হয়। এমনটাই চাইছেন ঝালদাবাসী। তাঁরা এ বার উন্নয়নের স্বার্থে আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটা স্থায়ী পুরবোর্ড চাইছেন।
২০১০ সালে ঝালদায় ১২টি আসনের মধ্যে ৩টি কংগ্রেস, ৩টি নির্দল, ৩টি সিপিএম, ২টি ফরওয়ার্ড ব্লক ও ১টি আসন বাম সমর্থিত নির্দলের পক্ষে যায়। অর্থাৎ ঝালদাবাসীর অনেকেই বামেদের সমর্থন জানিয়েছিলেন। বাকিরা জোটবদ্ধ না হওয়ায় ৬ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে বোর্ড গঠন করে বামেরা। পুরপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন সিপিএমের পঙ্কজ মণ্ডল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পঙ্কজবাবুর বিরুদ্ধে অনাস্থা আসে। কংগ্রেস ও নির্দলের ছয় কাউন্সিলরের সঙ্গে সেই অনাস্থা প্রস্তাবে সায় দেন ফরওয়ার্ড ব্লকের দুই কাউন্সিলরও। ঝালদা পুরসভায় অনাস্থা আনা সেই শুরু। ভোটাভুটির আগেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় পুরপ্রধানের পদে ইস্তফা দেন সিপিএমের পঙ্কজবাবু।
নতুন পুরপ্রধানের দায়িত্বে আসেন কংগ্রেসের প্রদীপ কর্মকার। গত পাঁচ বছরের ঝালদা পুরসভায় তিনিই বেশিদিন পুরপ্রধানের কুর্সিতে ছিলেন। কয়েকবছর পুরসভা চালানোর পরে প্রদীপবাবু ২০১৩ সালের শেষের দিকে কলকাতায় তৃণমূল ভবনে গিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে এক নির্দল কাউন্সিলর ও কংগ্রেসের এক কাউন্সিলরও তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূলে যোগদানের পরে বেশ কিছুদিন তৃণমূলের পুরপ্রধান হয়ে বোর্ড চালিয়েছিলেন প্রদীপবাবু। ঝালদায় এসে সভা করেন মুকুলবাবু। প্রদীপবাবুকে শহরের দলের দায়িত্বও দেওয়া হয়। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০১৪-র শেষের দিকে ফের অনাস্থা আসে পুরসভায়।
সিপিএমের পঙ্কজবাবুর বিরুদ্ধে যাঁরা অনাস্থা এনেছিলেন এবং যাঁদের সমর্থনে প্রদীপবাবু ক্ষমতায় বসেছিলেন এ বার তাঁদেরই একটা বড় অংশ কংগ্রেসত্যাগী প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন। সঙ্গ দেন তাঁরাও, যাঁরা প্রদীপবাবুর সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। ফরওয়ার্ড ব্লকের কাউন্সিলররাও অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। প্রদীপবাবু অবশ্য ইস্তফা দেননি। অনাস্থায় ভোটাভুটিতে হেরে পদ খোয়াতে হয় তাঁকে। পুরপ্রধানের চেয়ারে বসেন নির্দল প্রার্থী তথা ঝালদার পরিচিত শিল্পগোষ্ঠী পরিবারের সন্তান সুরেশ অগ্রবাল। তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্য আর অনাস্থা আসেনি।
গত পাঁচ বছরে ঝালদা পুরসভার ক্ষমতার অলিন্দে বারবার রদবদল এবং দলবদলের ঘটনা ঘটেছে। পুরভোটের মুখে তৃণমূল ছেড়ে প্রদীপবাবু ফিরে এসেছেন সেই কংগ্রেসে। পঙ্কজবাবু দলীয় প্রতীক ছেড়ে এ বার বাম সমর্থিত নির্দল হয়ে ফের ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছেন। গতবারের পুরবোর্ডের অনেকেই এ বারও হাজির ভোটের ময়দানে। অন্যবারের মতোই এ বারও সকলের মুখে মুখে উড়ছে উন্নয়নের আশ্বাসের ফিরিস্তি।
ঝালদাবাসী কিন্তু বলছেন, ঝালদা রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই। ছোট্ট এই শহরটার মূল যে সমস্যা পানীয় জল সেই সমস্যারই সমাধান হয়নি আজও। ঝালদার টাউন হলের শিলান্যাস হয়েছিল গত ভোটের আগে। সেই হলের কাজ এগোয়নি। ঝালদার বুক চিরে চলে যাওয়া পুরুলিয়া-রাঁচি সড়কের দু’পাশে ঝালদা জনপদের অবস্থান। এই রাস্তা ঘিরে যানজটও কাটেনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, জ্বলন্ত সমস্যাগুলো কাটাতে গত পাঁচ বছরে পুরসভাকে কোনও উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
ঝালদার বাসিন্দা কাঞ্চন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘শহরের উন্নয়নের কথা ভাবার সময় কোথায়? সমস্যা দীর্ণ একটা শহর হয়েই রয়ে গিয়েছে ঝালদা। অন্য পুরশহরগুলো কিছুটা এগোলেও আমরা তো সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।’’ ঝালদার আর এক বাসিন্দা অমিত সিংহ দেওয়ের কথায়, ‘‘ঝালদার সবচেয়ে বড় সমস্যা পানীয় জল। গ্রীষ্মে জলের সমস্যা আজও মেটেনি। আর যাঁরা জিতে পুরসভায় যাচ্ছেন তাঁরাও এ দল-ও দল করে সময় কাটিয়ে দিলেন। এ বার আমরা চাই যাঁরাই ক্ষমতায় আসুন, এ বার তাঁরা ঝালদায় সত্যিকারের কাজ করুন। এ রকম ভাবে তো চলতে পারে না।’’
প্রাক্তন পুরপ্রধান পঙ্কজ মণ্ডল দাবি করেছেন, ‘‘স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় থেকেই আমি পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে সুবর্ণরেখা নদী থেকে জল নিয়ে আসার পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছিলাম। বস্তি এলাকার আবাসন প্রকল্প নিয়েও কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমাকে তো কাজ করতে দেওয়া হল না। সরিয়ে দেওয়া হল।’’ তিনিও মানছেন, ঝালদার উন্নয়নের জন্য আগামী ৫ বছরে স্থায়ী পুরবোর্ড দরকার।
তাঁদের দুই কাউন্সিলর কংগ্রেস ও নির্দলদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অনাস্থা এনে বামফ্রন্টের বোর্ডের পতন ঘটিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লকের বিরুদ্ধে। ফরওয়ার্ড ব্লকের ঝালদা শহর লোকাল সম্পাদক অসিত কান্দু বলছেন, ‘‘পরিস্থিতির বিচারে আমাদের কাউন্সিলর অনাস্থার পক্ষে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এ বার আমরা ঝালদার মানুষকে স্থায়ী বোর্ড দেওয়ার অনুরোধই জানাচ্ছি।’’
আর আর এক প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রদীপ কর্মকার বলছেন, ‘‘আমি পুরপ্রধান থাকাকালীন সুবর্ণরেখা নদী থেকে পানীয় জল নিয়ে আসার প্রকল্প বিধায়কের মাধ্যমে কলকাতায় জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই কাজ তো আর এগোলই না।’’
তবে ঝালদাকে পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে তিনি সফল বলে দাবি করেছেন। আর বিদায়ী পুরপ্রধান সুরেশ অগ্রবালের দাবি, ‘‘আমার সময়ে যে কাজ হয়েছে আগে কেউই তা করেননি।’’
তিন পুরপ্রধানই নিজের মতো করে তাঁদের আমলেই উন্নয়নের দাবি করেছেন। কিন্তু ভোটাররা তা মানছেন তো? রাজনীতির আবর্ত থেকে বেরিয়ে পুরবাসী এখন শুধুই উন্নয়ন চাইছেন। তাঁদের মন কি পড়তে পারছেন রাজনীতির কারবারিরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy