পাথর খাদানের শ্রমিকেরা ধূলিকনাজনিত কোনও অসুখে আক্রান্ত কিনা দেখতে চলতি মাসের আট তারিখ থেকে চার দিনের স্বাস্থ্য-সমীক্ষা শিবির চলছে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে। মিলিত ভাবে এর আয়োজক কেন্দ্রীয় সরকারের খনি মন্ত্রণালয়ের আওতায় থাকা এনআইএমএইচ (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মাইনারস্ হেলথ) ও ডিজিএমএস (ডাইরেক্টটোরেট জেনারেল অফ মাইনস সেফটি)। কিন্তু, যাঁদের কথা ভেবে সমীক্ষা, সেটা তাঁদের কতটা কাজে লাগবে সেই প্রশ্ন উঠছে।
আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আদিবাসী গাঁওতা নেতা রবীন সরেন, সুনীল সরেনরা বলছেন, ‘‘বীরভূমের পাঁচটি ব্লকে থাকা পাথর শিল্পাঞ্চলে যত শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই আদিবাসী। এই সময় বাঁধনা ও সহরায় পরব চলছে। তাতেই মজে আছেন আদিবাসী মানুষ। তাঁদের কাছে সঠিক খবরও নেই। অনেকে জেনেও শিবিরে আসতে চাইছেন না।’’ এই সময়ে স্বাস্থ্য সমীক্ষা করা হলে কেউ কোনও অসুখে আক্রান্ত কিনা তার প্রকৃত চিত্রটা কী ভাবে বোঝা যাবে, প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
পাথর শিল্পাঞ্চলে কাজে যুক্তদের মারণ বক্ষরোগ সিলিকোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বাস্থ্য দফতর জানাচ্ছে, এটি এমন একটি রোগ যার মূলে রয়েছে ক্রিস্টালাইজড সিলিকা বা স্ফোটিকাকৃতি বালি বা পাথরের কণা। যেখানে এমন কণা উড়ছে, দীর্ঘ দিন সেই পরিবেশে কাজ করলে বালি, পাথরের কণা জমে জমে ফুসফুসের উপরি ভাগের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে এই রোগ হতে পারে। উপসর্গ বুকে ব্যথা শ্বাসকষ্ট, জ্বর, শেষ দিকে শরীর নীলাভ হয়ে যাওয়া। চিকিতসা না হলে পরিণতি মৃত্যু। যেহেতু বীরভূমের পাঁচটি ব্লকে পাথর খাদান রয়েছে, সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতেই সমীক্ষা।
যদিও পরিবেশ আদালতের ছাড়পত্র না মেলায় এবং শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের নিয়ম মেনে লিজ না নেওয়ায় জেলার ২১৭টি পাথর খাদানের মধ্যে কাগজে কলমে বন্ধ ২১১টি খাদান। বন্ধ থাকার কথা জেলার এক হাজারেরও বেশি ক্রাসার। যদিও আড়ালে ‘সবই চলছে’ বলে অনেকের দাবি। সেখানে কাজ করছেন দশ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। তাই ধূলিকণাজনিত রোগ হওয়া স্বাভাবিক। অনেক সময় পাথরগুঁড়ো ফুসফুসে জমে পাথুরে স্তর তৈরি করে। ফলে শ্বাসবায়ু থেকে টেনে নেওয়া অক্সিজেন রক্তে মিলে যেতে বাধা পায়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট, কাশি, জ্বর। এর লক্ষণগুলি অনেকটা যক্ষ্মার মতো। তাই অনেক রোগীকেই ডাক্তাররা কেবল যক্ষ্মার চিকিৎসা করেন। ফলে রোগটা ঠিক কী, অনেক ক্ষেত্রে সেটা বোঝার আগেই বিপদ থাবা বসায়। পাথর কাটা ও গুঁড়ো করার সময়ে শ্রমিকদের মুখোশ দেওয়ার কথা। কিন্তু, বেনিয়ম সেখানেও। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় থেকে বীরভূমের পাড়ুই পর্যন্ত বিশাল পাথরের স্তর রয়েছে। এর প্রায় সর্বত্রই এক ছবি। যদিও নিয়ম না মানার কথা মানতে চাননি খাদান মালিকরা।
আদিবাসী গাঁওতার নেতা সুনীল সোরেন ও রবীন সরেনদের দাবি, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে কেন্দপাহাড়ির দেবু রাউত এবং তালবাঁধ গ্রামের মিছু মুর্মু নামে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু মাত্র পুনর্বাসন দেওয়ার জন্যই মৃত্যুর কারণ হিসেবে রোগের নাম লেখা হয়নি। তাঁদের দাবি, নলহাটি ১, রামপুরহাট ১ ও মহম্মদবাজার ব্লকে যে পাথরখাদান রয়েছে, সেখারকার অনেক শ্রমিকই সিলিকোসিসে আক্রান্ত। সরকারের তরফে সিলিকোসিস নির্ণয়ে অনিচ্ছা, অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। শ্রমিক আন্দোলনের অনেকে মনে করছেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় এড়াতেই সিলিকোসিস নির্ণয় এড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। একই অভিযোগ কেন্দ্রীয় সরকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের বিরুদ্ধেও।
স্বাস্থ্য সমীক্ষার দায়িত্বে থাকা ডেপুটি ডিরেক্টর (মাইনস সেফটি) মনোজকুমার সাহু বলেন, ‘‘এটা প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয় নয়। এটা একটা সমীক্ষা। এক একটি অঞ্চল ধরে বেশ কিছু মানুষের (বিশেষত যাঁদের বয়স বেশি অথবা কোনও সমস্যায় ভুগছেন) তাঁদের খাদানে কাজ করার ইতিহাস, রক্ত পরীক্ষা, লাং ফাংশন টেস্ট ও এক্স-রে করানো হচ্ছে। সোম, মঙ্গল ভিড় একটু কম হলেও বুধবারই ১৫০ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় তথ্য নেওয়া হয়েছে।’’ সিলিকোসিসের কোনও লক্ষণ মিলল কি? মনোজবাবুর দাবি, কেস-স্টাডি করার পরেই সেটা জানা যাবে। তাঁর কথায়, ‘‘রিপোর্ট মন্ত্রককে দেওয়া হবে। তারপরে সিদ্ধান্ত হবে এখানে সকলের শারীরিক পরীক্ষা করানোর বা প্রয়োজনীয় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’’ তবে বাঁধনা পরবের সময় সমীক্ষা হচ্ছে বলে কিছু শ্রমিক কম হচ্ছে, মানছেন বীরভূম পাথর শিল্পাঞ্চল মালিক সমিতির সম্পাদক কমল খান ও সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিকেরা। তবে তাঁরা গাড়ি দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করছেন, প্রত্যেককে খবর দিয়েছেন— এমনই দাবি করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy