Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
গড়গড়িয়া

শিবির শেষে লাউ পেলেন ডাক্তার

মির্জাপুরের পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই দিনমজুর সোলেমান শেখ একটু জোরেই হাঁটছেন। সঙ্গের ঝোলায় ঘাস-পাতা লাগা মাঠ থেকে তুলে আনা টাটকা সব্জি। থেকে থেকেই পথে লোক দেখে তিনি জিজ্ঞেস করছেন, ‘‘সব হয়ে গেল নাকি ভাই!’’

শরীর পরীক্ষা করাচ্ছেন এলাকার দুঃস্থ মানুষ। —নিজস্ব চিত্র

শরীর পরীক্ষা করাচ্ছেন এলাকার দুঃস্থ মানুষ। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:২৯
Share: Save:

মির্জাপুরের পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই দিনমজুর সোলেমান শেখ একটু জোরেই হাঁটছেন।

সঙ্গের ঝোলায় ঘাস-পাতা লাগা মাঠ থেকে তুলে আনা টাটকা সব্জি। থেকে থেকেই পথে লোক দেখে তিনি জিজ্ঞেস করছেন, ‘‘সব হয়ে গেল নাকি ভাই!’’ বছর চুয়াল্লিশের কৃষক, সইসপুরের বাসিন্দা বাবলু মুর্মু যেমন। হন্তদন্ত হয়ে সাত সকালেই হাজির। ভিড় ঠেলে মাথা উঁচু করে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘দেখানো যাবে তো?’’ রবিবার বোলপুর-সিউড়ি রাস্তার উপর অমরপুর পঞ্চায়েতের গড়গড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে এমন উৎকণ্ঠার ভিড়ে সামিল স্থানীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক গদাধর দাস থেকে অবসরপ্রাপ্ত সেবিকা উষারানি মণ্ডল, রিনা ধীবর, তসলিমা বিবিরাও। সোলেমানের মতো তাঁরাও কেউ কেউ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের বিনা পয়াসায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার শিবিরে সঙ্গে এনেছেন ঝোলা-ঝুড়িতে সব্জি!

রোগ দেখানোর এ কেমন দস্তুর!

ভিড়েই মিলল উত্তর। জানা গেল, গড়গড়িয়া গৌরব কমিটির উদ্যোগে এ দিন ছিল বিনাপয়সায় স্বাস্থ্য শিবির। তবু গাঁ-ঘর থেকে চিকিৎসা করাতে আসা রোগীরা ডাক্তারবাবুর জন্য সঙ্গে এনেছিলেন মাঠের সব্জি। তাঁরাই জানালেন, এসব স্বেচ্ছাতেই ডাক্তারবাবুর জন্য এনেছেন। রোগীদের হাতে লাউ, মোচা দেখে প্রশ্ন করতেই এক রোগীর উত্তর, ‘‘বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতে এসেছেন ডাক্তারবাবু। তাঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন। এসবই তাঁদের জন্য আমাদের তরফে সামান্য উপহার!’’

কমিটির উদ্যোগেই ওই হাসপাতালকে রোগী পরিষেবার কেন্দ্র করে তোলা হয়েছে কিছুদিন আগে। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জলা, ঝোপ, জঙ্গলে ভরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা পরিষেবা বেহাল দশা দেখে ঘনিষ্ঠ মহলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন গায়ক ও অভিনেতা শিলাজিৎ। তাঁর বাড়িও এই গ্রামেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, গ্রামের ছেলে শিলুর উদ্যোগেই হাসপাতাল পরিষ্কার হয়েছে। গড়গড়িয়ায় গৌরব কমিটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন শিলু। তিনিই কমিটির উপদেষ্টা। ওই কমিটির কাজকর্ম দেখে জনসেবামূলক এমন কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন স্থানীয় মানুষ থেকে পঞ্চায়েত। কমিটি উদ্যোগে পড়ুয়াদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয়েছে। এসবের পরেই হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে আসার কথা ভাবে কমিটি। কমিটির পক্ষে সভাপতি তাপস মজুমদার ও সম্পাদক বিদ্যুৎ মণ্ডল বলেন, ‘‘ঝাঁটা, ঝুড়ি নিয়ে গ্রামবাসীদের সহযোগে হাসপাতাল পরিস্কারে নেমেছিলাম। এ বার কমিটির উপদেষ্টার উদ্যোগে বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া শুরু হয়েছে।’’

এ দিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা রিনা ধীবর, তসলিমা বিবিরা। তাঁরা জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জয়দীপ পাল দেখছেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার ইসিজি, সুগার টেস্টও করানো হচ্ছে। তাঁরা বলেন, ‘‘শিলুবাবু খুব ভাল উদ্যোগ নিয়েছেন। সকাল ন’টা থেকে টানা তিনটে পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে রোগী দেখা চলেছে।’’

গ্রামের ভৈরব মজুমদার ও সত্যকিঙ্কর মজুমদারদের দান করা দশ বিঘে জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এমন ভোল বদলের গল্প এখন তাঁদের মুখে মুখেই পড়শি গাঁ-ঘরে ঘুরছে। গত এক দশক ধরে, যে জায়গা সন্ধ্যাবেলা নেশাড়ুদের দখলে চলে যেত, সেখানেই রবিবার ছুটির দিনে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর জন্য ঠাসাঠাসি ভিড় বাসিন্দাদের। চিকিৎসক জয়দীপবাবুর সঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানের গবেষিকা স্ত্রী অর্পিতা দেবীও রোগী দেখতে সহায়তা করছেন। রোগীদের নামের তালিকা আশি ছাড়িয়েছে। ওই তালিকায় চোখ বুলিয়ে, কার্যত স্বস্তি দেখাল শিলাজিৎকে। নিজের তাগিদে বিভিন্ন মহলে চিকিৎসা নিয়ে খোঁজ খবর শুরু করেছিলেন বছর খানেক আগে। সেখানে বিনামূল্যে কলকাতা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো যায় কিনা ভেবেছিলেন সে নিয়েও। জয়দীপবাবু এবং অর্পিতা দেবী বলেন, “এ এক অন্য রকমের অভিজ্ঞতা। ভালবাসা কি ভাষায় প্রকাশ হয়।”

আর শিলাজিৎ?

তিনি বলেন, ‘‘স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিনামূল্যে তো নয়। গ্রামের মানুষদের ভালবাসার বিনিময়ে এই পরিষেবা। দেখছেন কি অবস্থা। ডাক্তারবাবুকে দেবে বলে, শাক, সব্জি নিয়ে হাজির হচ্ছেন বাসিন্দারা। আমরা ফি মাসে কোনও না কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে নিয়ে আসার কথা ভাবছি।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Free Treatment cam Social work
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy