রাস্তায় সুর তুলেছেন বিপ্লব। নিজস্ব চিত্র।
জন্মান্ধ হওয়ায় লেখাপড়ার তেমন সুযোগ পাননি। পারিবারিক পেশা ছিল চাষাবাদ। সেটাও চালানো ছিল সমস্যার। কারণ, দৃষ্টিশক্তি না থাকা। অগত্যা কিছু একটা করার বাসনায় ছোটবেলায় নিজেই শিখেছিলেন বাঁশি বাজানো। নাম-যশও ভালোই হয়েছিল। ডাক পেতেন যাত্রাদলে। বাঁশি বাজাতেন। কিন্তু করোনা কেড়েছে সেই পেশা। এখন বাঁকুড়ার নদাডিহি গ্রামের ‘হ্যামলিন’ বিপ্লব পাত্রের মঞ্চ হয় কখনও বাঁকুড়া শহরের বাসস্ট্যান্ড, কখনও রাস্তার মোড়। বাঁশি শুনে পথচলতি কোনও কোনও মানুষ থমকান। তাঁরা সামান্য যে সাহায্য তুলে দেন, তাতেই কোনও মতে চলে সংসার।
‘শিক্ষানবিশ’ হোক বা ‘পেশাদার’, বাঁকুড়া জেলায় যাত্রাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সকলেই এক ডাকে চেনেন নদাডিহি গ্রামের বিপ্লবকে। বছর দুয়েক আগে বাঁকুড়া শহরের যাত্রাদলগুলিতে ছিল বিপ্লবের ‘একচেটিয়া দখলদারি’। মঞ্চে কুশীলবদের হাসি, কান্না, প্রেম-বিরহ , দুঃখ-যন্ত্রণায় সঙ্গী হত বিপ্লবের বাঁশি। শুরুটা খুব ছোটবেলায়। চোখের দৃষ্টি না থাকলেও অন্যের অনুভূতিকে বাঁশির সুরে বাঁধতে চেয়েছিলেন বিপ্লব। বাঁশ কেটে নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন বাঁশি। আর বাঁশি বাজানোর বিদ্যা আয়ত্ত হতেই টুকরো বাঁশ অথবা লোহার পাইপ দিয়ে ঘরোয়া ভাবে তৈরি বাঁশি বাজানো শুরু করেন বিপ্লব। প্রথম প্রথম গ্রামের মনসামঙ্গল দলের সঙ্গে বাঁশি বাজাতেন বিপ্লব। ধীরে ধীরে ডাক পেতে শুরু করেন নাম কীর্তন, পালাকীর্তন, ব্যান্ড পার্টির দলে। বাঁশি বাজানোর সুযোগ মেলে আজ থেকে বছর তিরিশ আগে। তার পর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিপ্লবকে। গ্রাম-গ্রামান্তরে যেখানেই বসেছে যাত্রার আসর, সেখানেই ডাক পড়েছে বিপ্লবের। মঞ্চের পাশে বসে বাঁশিতে মেঠো সুর তুলে ছুঁয়ে ফেলেছেন হাজার হাজার দর্শকের হৃদয়।
অনেকের মতো বছর দু’য়েক আগে আসা করোনা উল্টেপাল্টে দিয়েছে বিপ্লবের জীবন। একে তো যাত্রাশিল্পের পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। করোনার কারণে সরকারি নির্দেশে দীর্ঘ দিন যাত্রা বন্ধ থাকায় বিপ্লবের রোজগার তলানিতে ঠেকে। বিপ্লব বলেন, “এক সময় যাত্রার রমরমা বাজার ছিল। জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে যাত্রা হত। পুজোর দু’মাস আগে থেকেই আসতে শুরু করত বরাত। কিন্তু গত এক দশক ধরে এমনিতেই কম ছিল যাত্রার সংখ্যা। তার উপর করোনা যাত্রা শিল্পে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে। অগত্যা আলো ঝলমলে মঞ্চের ধার ঘেঁষে বাজনাদারের আসনে নয়, সকাল হলেই রাস্তায় রাস্তায় বাঁশি বাজিয়ে বেড়াই। বাঁশি শুনে পথচারীরা যা দেয়, তা দিয়েই কোনও আমার সংসার চলে।”
বাঁকুড়ার নদাডিহি গ্রামের এক কক্ষের চালার ঘর বিপ্লবের। বড় মেয়ের বিয়ের পর আপাতত স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে অভাবের সংসার শিল্পীর। ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। বিপ্লব বলেন, “বরাত না পাওয়ায় মনখারাপ করে বাড়িতে বসে থাকলে রেওয়াজটাও তো বন্ধ হয়ে যেত। আর শিল্পীর শিল্পচর্চা নিয়ে লাজলজ্জা থাকতে নেই। তাই রাস্তাকেই বেছে নিলাম আমার মঞ্চ হিসাবে।” কিন্তু এ ভাবে কি আদৌ চলে এত বড় সংসার? একগাল হাসি হেসে বিপ্লবের সটান জবাব, “লক্ষ্মী থাকলে সরস্বতী থাকে না। আমি সরস্বতীর পূজারী।” কথাগুলো বলতে বলতেই মাটিতে লাঠি ঠুকে ঠুকে রাস্তার এক মঞ্চ থেকে অন্য মঞ্চে হাঁটা দিলেন মধ্য পঞ্চাশের বিপ্লব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy