প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে লোকটা যে কোথায় গেল! মকপোল শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই, অথচ তৃতীয় পোলিং অফিসারের দেখা নেই। সে দিন ওই মানুষটি আমাদের সবাইকে যা দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছিলেন, এমন অভিজ্ঞতা আমার আগে কোনও দিন ভোট করাতে গিয়ে হয়নি।
১০ এপ্রিল ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে অমরকাননের কোরো পাহাড়ের কাছে, বড়জোড়া বিধানসভার ১৮০ নম্বর বুথে (মালকোড় মৌতোড়া নিম্নবুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়) ঢুকে দেখি চারপাশ গাছগাছালিতে ভরা। স্কুলবাড়ি মোটের উপর ঠিকঠাক। একটি নলকূপও রয়েছে। দু’টি শৌচাগারও রয়েছে। কিন্তু তার একটিতে তালা, অন্যটির দরজা খোলা থাকলেও ব্যবহার করার জো নেই। ভোটের দিন খুব ভোরে উঠে কোথায় প্রাকৃতিক কাজ সারতে যাব— সবাই যখন এই চিন্তায়, তখনই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে তৃতীয় পোলিং অফিসার জানালেন, তিনি আর সামলাতে পারছেন না। এই বলে একাই তিনি হনহনিয়ে পুকুরের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন।
অনেক ভেবেটেবে উপায় না পেয়ে আমরা বাকি তিন ভোটকর্মী স্কুলের পিছনের জঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগালাম। বরাত ভাল সেই জঙ্গলের মধ্যেই একটি ভাঙা বালতি ও মগ খুঁজে পেয়ে গেলাম। স্কুলের নলকূপ থেকে ভাঙা বালতিতে জল ভরে নিয়ে গিয়ে একে-একে হাল্কা হয়ে এলাম।
এ দিকে সকাল ছ’টা থেকে সর্বদল মকপোল শুরু করার কথা। কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় যখন সাড়ে পাঁচটায়, তখনও আমাদের সেই তৃতীয় পোলিং অফিসারের দেখা নেই। বেশ কয়েকবার তাঁর মোবাইলে ফোন করলাম। কিন্তু তাঁর ফোনের নেটওয়ার্ক ছিল না। এ দিকে হাতেও আর সময় নেই। ওই পোলিং অফিসারকে ছাড়া ভোটই বা শুরু করব কী করে, এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম সবাই। তখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি। অন্য দুই পোলিং অফিসারকে তৃতীয় পোলিং অফিসারের খোঁজ করতে যেতে বললাম। তাঁরা গ্রামের মাঠঘাট, পুকুর লাগোয়া ঝোপ-ঝাড়ে টর্চের আলো ফেলে দেখে এলেন। কোথাও ওই ভোটকর্মীর দেখা নেই। যা বাব্বা, মানুষটা তবে গেল কোথায়? অচেনা জায়গায় ভোরের অন্ধকারে কোনও বিপদে পড়লেন না তো?
টেনশনে পড়ে সবে সেক্টর অফিসারকে ফোনে ধরতে যাচ্ছি, সেই সময় দেখি দু’হাতে পেট চেপে ওই ভোটকর্মী মাঠের আলপথ ধরে বুথের দিকে হেঁটে আসছেন। তাঁকে দেখে আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ এল!
ব্যাপার কী?
ওই ভোটকর্মী কাঁচুমাচু মুখে জানালেন, পেটের সমস্যা। ঘন ঘন চাপ পড়ছে তাঁর। ওষুধ খাইয়ে তাঁকে সুস্থ করা হল। শেষ পর্যন্ত ঠিক সময়েই মকপোল ও ভোট গ্রহণ শুরু করা গিয়েছিল।
এ বারের বুথের অভিজ্ঞতা যে সুবিধার হবে না, তার কিছুটা ইঙ্গিত যেন ভোটের আগের রাতেই আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম। অফিসাররা জানিয়েছিলেন, স্কুলের মিড-ডে মিলের রান্নার দায়িত্বে থাকা স্বনির্ভর গোষ্ঠীই ভোটকর্মীদের ন্যায্যমূল্যে খাবার দেবে। কিন্তু সন্ধ্যা পার হয়ে গেলেও তাঁদের দেখা যায়নি। রাতে কি তবে হরি-মটর? সবাই যখন এই দুর্ভাবনায়, তখনই এক যুবক এসে আমাদের জানান, মাথা পিছু তাঁকে ৩০ টাকা দিলেই মিলবে গরম ভাত, আলুপোস্ত ও ডিম। এই নিবার্ন্ধব পুরীতে এ তো তোফা খাবার! কিন্তু তা কপালে থাকলে তো!
আধঘণ্টা পরেই ওই যুবক এসে জানালেন, ৩০ টাকায় হচ্ছে না, জনপ্রতি ৫০ টাকা করে লাগবে। তাই মেনে নিই। রাত সাড়ে ৯টায় যখন আমরা ভাবছি, এই বুঝি খাবার আসছে, সেই সময় ওই যুবক এসে জানালেন, রেট-এ তাঁর পোষাচ্ছে না। জনপিছু ৮০ টাকা দিলে শুধু ডিম আর ভাত দেওয়া হবে। পরে ভাত নিলে ‘চামচ’ পিছু আরও ১০ টাকা। ফাজলামি হচ্ছে না কি! আমরা চটে গিয়ে তাঁকে সোজা দরজা দেখিয়ে দিই। ভোটকর্মীদের যাঁর কাছে যা ছিল চিঁড়েভাজা, কেক, বিস্কুট অল্পসল্প করে চিবিয়ে চাট্টি জল খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দিলাম।
এই নিয়ে ছ’বার ভোটের ডিউটি করলাম। কিন্তু এত বাজে অভিজ্ঞতা আগে হয়নি।
(লেখক বাঁকুড়ার মগড়া হাইস্কুলের সহ-শিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy