ব্যস্ত শিল্পী। রঘুনাথপুরের পুরাতন বাজারে। ছবি: সঙ্গীত নাগ।
থিমের দাপটে সাবেক একচালা প্রতিমার পুজো প্রায় উঠে গিয়েছে। ডাকের সাজ তৈরির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। তার উপরে উৎসবে লেগেছে করোনার ধাক্কা। সব মিলিয়ে কার্যত অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছে ডাকের কাজের শিল্প। এমনই দাবি ওই কাজে যুক্ত বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, বড়জোড়া ও পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর শহর ও আড়শার বামুনডিহা গ্রামের শিল্পীদের।
প্রতিমায় ডাকের সাজের জন্য প্রয়োজন মুকুট, কানপাশা, হার, চুড়ি, কানের দুল, কুন্তল, গলার চিক-সহ অনেক কিছু। সেগুলি বানান শিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে রঘুনাথপুরের বাদলচন্দ্র রেওয়ানি, নরেন্দ্রনাথ সেনদের কথায়, ‘‘করোনা পরে কাঁচামালের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে জরির দাম ছিল ২১০ টাকা প্রতি কেজি। এখন হয়েছে ৩০০ টাকা। দাম বেড়েছে থার্মোকল-সহ সব সামগ্রীর।’’
শিল্পীদের দাবি, আগে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুজো উদ্যোক্তারা রঘুনাথপুরে এসে ডাকের সাজ কিনতেন। গত দু’বছরে এসেছেন হাতেগোনা কয়েকজন। বাদলচন্দ্র রেওয়ানি বলেন, ‘‘স্থানীয় ভাবে বিক্রি খুব একটা বেশি হয় না। ঝাড়খণ্ডের ক্রেতারা বড় ভরসা ছিলেন। তাঁরা মুখ ফেরানোয় বিক্রি লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে।”
বামুনডিহার যোগীপাড়ার গোটা দশেক পরিবার ডাকের সাজের কাজের সঙ্গে জড়িত। তাঁদেরও একই অবস্থা। শিল্পীরা জানান, আগে কুড়িটির মতো পরিবার ডাকের সাজ তৈরি করত। ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় অনেকেই অন্য পেশায় চলে গিয়েছেন। দিলীপ যোগী জানান, একটি প্রতিমার ডাকের সাজ শেষ করতে সাত থেকে আট দিন লাগে। পুরো পরিবার মিলে দিনে আট থেকে ন’ ঘণ্টা কাজ করার পরে, যে টাকা পাওয়া যায়, তাতে অনেক সময় পোষায় না। দিলীপের কথায়, ‘‘আগে বাজার মোটের উপরে ভালই ছিল। এখন খুব বেশি হলে, তিন থেকে চারটি কাজের বরাত আসে। এ ভাবে চললে আর কত দিন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারব জানি না!” দুই শিল্পী শ্রীদাম যোগী ও স্বপন যোগী জানান, আগে ২০-২৫ হাজার টাকার কাজের বরাত পেতেন। এখন তার অর্ধেকও আসে না।
বিষ্ণুপুরের শাঁখারিবাজারের ডাকের গহনা তৈরি করেন অনেকে। শিল্পী মনোরমা দাসের প্রশ্ন, ‘‘বাঁকুড়ার পদ্মফুল যদি অস্ট্রেলিয়া যেতে পারে, তবে বিষ্ণুপুরের ডাকের গহনা কেন নয়। বিপণনের জন্য প্রশাসন পদক্ষেপ করলে, দু’পয়সার মুখ দেখতে পাই। পুজোর সময়ে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ডাকের গয়না তৈরি করি। রোজগার তেমন হয় না। তবুও পেশা ছাড়িনি।’’
কলকাতা থেকে ডাকের গয়না তৈরির কাঁচামাল আসে। করোনা-পরিস্থিতিতে বাইরের ক্রেতারা এখন বিষ্ণুপুর আসছেন না। কম-বেশি ৪০ বছর ধরে ডাকের গয়না তৈরি করছেন বিষ্ণুপুরের সবিতা পাত্র। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘এখানকার ডাকের গয়নার খ্যাতি থাকলেও বাইরে তার বিপণনের ব্যবস্থা হচ্ছে না। পুজোর সময় ডাকের গয়না তৈরি করে দু’পয়সার মুখ দেখি। দু’বছর ধরে চাহিদা তেমন নেই। তবে গত বছরের থেকে এ বছরের পরিস্থিতি তুলনায় ভাল।’’ বড়জোড়ার জগন্নাথপুরের শিল্পী আনন্দ মালাকার বলেন, ‘‘গত বছর হাত গুটিয়ে বসেছিলাম। এ বার বরাত এসেছে। তবে ভিন্-রাজ্যের বায়না এ বছরও আসেনি।’’ বিষ্ণুপুরের শিল্পী দুলাল পাত্র, অনুপ পাত্র,অরুণ পাত্ররা জানান, ভিন্-জেলা থেকে বেশ কিছু বরাত জুটেছে, তবে বিহার, ওড়িশা থেকে কিছুই আসেনি। তাঁদের কথায়, ‘‘করোনা আমাদের ভাতে মেরেছে। শিল্পী-ভাতাও নেই। সব মিলিয়ে খুব কঠিন পরিস্থিতি।’’
মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) অনুপকুমার দত্ত বলেন, ‘‘বিষ্ণুপুরে একটি আর্ট গ্যালারি হচ্ছে। ইচ্ছা করলে ওই শিল্পীরা সেখানে তাঁদের শিল্পসামগ্রী বিক্রি ও প্রদর্শন করতে পারেন। বিষ্ণুপুরে পোড়ামাটির হাট এবং বিষ্ণুপুর মেলায় তাঁরা শিল্পসামগ্রী বিক্রি ও প্রদর্শন করতে চাইলে ব্যবস্থা করা হবে।’’ তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক (বিষ্ণুপুর) রামশঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘লোকশিল্পীদের ভাতা দেওয়ার সরকারি নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু ওই শিল্পীদের ভাতা দেওয়ার নির্দেশ এখনও নেই। এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy