শববাহী গাড়ি নিয়ে এ ভাবেই ছুটে বেড়িয়েছেন আতাউর। নিজস্ব চিত্র।
রমজান মাসের শেষ শুক্রবার। সূর্যোদয়ের আগে সারা দিনের মতো খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়েছিলেন। যখন বাড়ি ফিরলেন তখন ইফতারের সময় হয়ে গিয়েছে। দিনভর কাটল করোনায় মৃত এক ব্যক্তির সৎকারের বন্দোবস্ত করে, তাঁর পরিজনদের সাহায্য করে। রোজার মধ্যেই রামপুরহাটের বাসিন্দা আতাউর রহমানের এই ভূমিকাকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন সকলেই।
শুক্রবার, ভোরের নমাজ শেষে বাড়িতে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রামপুরহাট পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ডাকবাংলা পাড়ার বাসিন্দা আতাউর। চোখে ঘুম লাগতেই কাছে থাকা মোবাইল বেজে ওঠে। পেশায় গৃহশিক্ষক বছর ছেচল্লিশের আতাউর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সক্রিয় সদস্যও। ভোরে তাঁকে ফোন করেছিলেন সংগঠনের সভাপতি সামিউল ইসলাম। তাঁর কাছ থেকেই ‘আতা মাস্টার’ (আতিউরের ডাক নাম) জানতে পারেন তাঁকে তখনই রামপুরহাটের হাসপাতালপাড়ায় বেরিয়ে যেতে হবে। সেখানে একটি নার্সিং হোমে বাঁকুড়ার বাসিন্দা এক করোনা আক্রান্ত যুবকের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের দাদা অসহায় অবস্থায় একা রয়েছেন, কারণ এখানকার কিছুই তিনি চেনেন না। মৃতদেহ কীভাবে কোথায় সৎকার করতে হবে ভেবে পাচ্ছেন না।
মৃতের পরিজনকে সাহায্য করতে তখনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আতাউর। ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে ওই নার্সিংহোমে পৌঁছন। মৃতদেহ সৎকার করে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন ইফতারের সময় হয়ে গিয়েছে। ইফতারে যোগ দিলেন। রমজান মাসের শেষ শুক্রবার জুম্মার নমাজে অংশগ্রহণ করতে পারেননি তিনি। তবুও রোজা রাখা অবস্থায় একজন অসহায় মানুষের পাশে থেকে মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করতে পেরে খুশি তিনি। আর অপরিচিত জায়গায় করোনা আক্রান্ত ভাইয়ের মৃতদেহ সৎকার করতে পেরে আতাউরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন বাঁকুড়ার ইন্দাসের হরিপুরের বাসিন্দা রাধারমণ কর্মকার। তাঁর কথায়, ‘‘ভগবান বা আল্লাকে চোখে দেখিনি, তবে আতাউর রহমান আমার কাছে ভগবান। উনি না থাকলে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ সময়মতো সৎকার করতে পারতাম না।’’
রাধারমন জানান, তাঁর ভাই ১৬ বছর ধরে বীরভূমের মহম্মদবাজারে ব্যবসা সূত্রে বাস করছেন। ৪মে তিনি ভাইয়ের অসুস্থতার কথা জানতে পারেন। তিনি রামপুরহাটের একটি নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন বলে ভাইয়ের স্ত্রী তাঁকে জানান। মৃত্যুর খবর পেয়ে রাধারমণ এলেও করোনা-আতঙ্কে পরিবারের লোকেরা বা অন্য আত্মীয়স্বজন কেউ রামপুরহাট আসতে চাননি। তাঁর কথায়, ‘‘মৃতদেহ কীভাবে কোথায় সৎকার করব তাই নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। শেষমেষ মহম্মদবাজারের এক যুবকের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সদস্য আতাউরকে পাশে পাই।’’ তিনি জানান, আতাউর সৎকার করার জন্য ডোমের ব্যবস্থা, শববাহী গাড়ির ব্যবস্থা থেকে সৎকার করার যাবতীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা একা হাতে করেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রখর রোদ উপেক্ষা করে রোজা রাখা অবস্থায় মৃতদেহ দাহ করার জন্য একবার নলহাটির জগধারী শ্মশান, একবার রামপুরহাটের বুঙ্কেশ্বরী তলার শ্মশানঘাটে ছোটাছুটি করেছেন আতাউর। ওঁর অবদান কোনওদিন ভুলতে পারব না।’’
বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সভাপতি সামিউল ইসলাম বলেন, ‘‘খবর পাই একজন করোনা আক্রান্ত যুবক মারা গিয়েছেন। সৎকার করার জন্য পাশে কেউ নেই। এই অবস্থায় আতাউরকেই পাশে দাঁড়ানোর জন্য বলি। আতাউর রোজা রাখা অবস্থায় একজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতার নজির গড়েছেন।’’ আতাউর নিজে বলেন, ‘‘শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে শববাহী গাড়ির চালক আকবর আলিও রোজা রাখা অবস্থায় করোনা আক্রান্ত যুবকের মৃতদেহ সৎকার করার জন্য নলহাটি থেকে রামপুরহাট ছোটাছুটি করেছেন। মানুষের বিপদে মানুষই যদি সাহায্যের হাত না বাড়ায় তাহলে কীসের আমরা সামাজিকতার বড়াই করি?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy