বিসর্জনের আগে। পুরুলিয়া ১ব্লকের রামনগরে। নিজস্ব চিত্র
হারমোনিয়াম, তবলা, পাখোয়াজ, মৃদঙ্গের সুরে মিশে যেত ভাদুগান। রাত বাড়ত, জমে উঠত আসর। ভাদ্র সংক্রান্তির আগের দিন ‘জাগরণের রাত’-এ এখনও মেতে ওঠে পুরুলিয়ার বিভিন্ন জনপদ। কাশীপুরে বেজে ওঠে পঞ্চকোট রাজ ঘরানার মার্গ সঙ্গীতের ভাদুগান। আবার পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার রামনগর বা ঘোঙা, বোরোর ধাদকিডি বা বান্দোয়ানের পারবাইদের মতো এলাকায় লোকায়ত ভাদুর গানে গলা মিলিয়েছেন মানুষজন। এ ভাবেই জাগরণের রাতে সুরে বাঁধা পড়ল পুরুলিয়ার গাঁ-গঞ্জ। তবে সুরের মায়াডোর কেটে অনেক জায়গাতেই প্রবল আওয়াজে ডিজে বক্স বেজেছে বলে আক্ষেপও রয়েছে।
লোক গবেষকদের মতে, রাঢ়বঙ্গের লৌকিক উৎসব ভাদুকে ঘিরে নানা লোকগাথা ছড়িয়ে রয়েছে। কেউ বলেন— ‘ভাদু পুজো’। কারও মতে— ‘ভাদু পরব’। কারও কাছে উৎসব। লোক গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, ‘‘সমগ্র মানভূম বা রাঢ়বঙ্গ জুড়ে ভাদুকে ঘিরে কত লোককথা ছড়িয়ে রয়েছে। তবে ভাদুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে পঞ্চকোটের নাম। যে সমস্ত লোকগাথাগুলি দীর্ঘকাল ধরে মুখে মুখে ছড়িয়ে রয়েছে, তার একাধিক লোকগাথা পঞ্চকোটকে ঘিরে।’’ তিনি জানান, কথিত রয়েছে, ভাদু পঞ্চকোট রাজবংশের মেয়ে ছিলেন। অনেকের মতে, ভাদুগানের সৃষ্টি হয়েছিল পঞ্চকোটের রাজ নীলমণি সিংহ দেওয়ের সময়ে। তিনিই ভাদুগানকে পঞ্চকোট রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। জেলার আর এক লোক গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, ‘‘ভাদু পুজোর নির্দিষ্ট আচার-আচরণ নেই। ভাদু সকলের ঘরেই পূজিতা হন। ভাদু লৌকিক দেবী। গানই এই পুজোর প্রধান উপচার।
মঙ্গলবার ভাদুর সঙ্গে রাত জেগে বুধবার ভাদু গান গাইতে গাইতে বিসর্জন দিতে যাওয়ার পথে রামনগর গ্রামের আলোমণি মাহাতো, কল্পনা মাহাতো, কবিতা মাহাতোরা বলেন, ‘‘ভাদু আমাদের ঘরের, বড় আদরের মেয়ে। বিদায় দিতে মন চায় না। তবু যেতে দিতে হবে।’’ আবহমান কাল ধরে পুরুলিয়ার মেয়েরা এই কথা বলে আসছেন।
সংক্রান্তির আগের রাতে পঞ্চকোট রাজঘরানার মার্গ সঙ্গীতের ভাদু গানের আসর বসেছিল পঞ্চকোটের শেষ রাজধানী কাশীপুরে। আসরের উদ্যোক্তা সঞ্চয় সূত্রধর বলেন, ‘‘এই বংশের উত্তরপুরুষ উদিতনারায়ণ সিংহ দেওয়ের কাছে বেশ কয়েকটি গানের তালিম পেয়েছিলাম।’’ তাঁর সঙ্গে সুশীল সা, ভুবন বাউরি, শুকদেব দে-সহ অন্য গায়কদের এক একটি রাগাশ্রয়ী নিবেদনে জমে ওঠে আসর।
পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরপুরুষ সোমেশ্বরলাল সিংহ দেওয়ের কথায়, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষদের এ রকম হাজার দুয়েক ভাদুগান রয়েছে। সবই মার্গসঙ্গীত মেনে রচনা করা।’’ সুভাষবাবু জানান, লোকায়ত ভাদু টিকে রয়েছে মুখে মুখে। কিন্তু পঞ্চকোট ঘরানার ধ্রুপদী ভাদুগানগুলি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই সঙ্গীত পুরুলিয়া তথা মানভূমের সম্পদ। এই গানগুলিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কাশীপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বিভাসকান্তি মণ্ডল বলেন, ‘‘আমাদের কলেজে লোকগান ও ভাদু বিষয়ে একটি ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রম চালু করেছি। পঞ্চকোট ঘরানার এই গানগুলিকে ধরে রাখার কাজ শুরু করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy