বাঁকুড়া পুরসভার কলে এমনই নোংরা জল পড়ছে দেখিয়ে অবরোধ শুরু হয়েছিল। পরে সেখান থেকেই কিছু লোক পুরভবনে ঢুকে পুরপ্রধানের গাড়ির কাচ ভাঙে, অফিসে তাণ্ডব চালায়। হামলার ভিডিও ফুটেজ দেখছেন পুরপ্রধান। ছবি: অভিজিৎ সিংহ
ছিল মামুলি পথ অবরোধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা বদলে গেল তাণ্ডবে। রণক্ষেত্রের চেহারা নিল বাঁকুড়া পুরভবন। জনা পঞ্চাশেক লোক পুরভবনে ঢুকে বেপরোয়া ভাবে ভাঙচুর চালাল। মঙ্গলবার এই নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী থাকল বাঁকুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র মাচানতলা।
এলাকায় পেটের রোগে ভুগছেন একের পর এক বাসিন্দা, অথচ ‘প্রশাসনের সহযোগিতা মিলছে না’। এমনই অভিযোগ তুলে প্রথমে পথ অবরোধে নেমেছিলেন স্থানীয় লোকজন। পরে সেই অবরোধই বদলে গেল তাণ্ডবে। পুরপ্রধানের গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়ে, মোটরবাইক উল্টে দিয়ে ক্ষীপ্ত লোকজন পুরসভার জলকল দফতর ও অর্থ দফতরে ঢুকে চেয়ার-টেবিল উল্টে দিল। পুরসভার কর্মীদেরও রেয়াত করেনি তারা। তাঁদেরও হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে। তাণ্ডবের ছবি করতে গিয়ে মার খান একটি দৈনিকের চিত্র সাংবাদিক।
পুরো ঘটনাটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং কংগ্রেস-সিপিএমের মস্তিষ্ক প্রসূত বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের পুরপ্রধান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এই ঘটনায় সরকারি কর্মীদের মারধর, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা-সহ বিভিন্ন ধারায় মোট ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে নাম রয়েছে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর বিশ্বজিৎ দাস, সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অশোক রায়েরও। পুরভবনে থাকা সিসিটিভির-ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে পুরসভা সূত্রে খবর।
বাঁকুড়ার পুরপ্রধানের অভিযোগ, ‘‘বিরোধীদের জোট পুরসভায় এই হামলার ছক আগের রাতেই কষেছিল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এ দিন কিছু লোকজনকে নিয়ে পুরভবনে হামলা চালানো হয়েছে।’’ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের জেলা কোর কমিটির সদস্য অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “আমি লিখিত ভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে সিপিএমের এই চক্রান্তের অভিযোগ জানিয়েছি। এলাকায় পরিশুদ্ধ জল সরবরাহ শুরু হয়ে গিয়েছে বলেই ওরা এখন ব্যাকফুটে। তাই এই সব করল।” যদিও তাঁদের বিরুদ্ধো তোলা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিপিএমের বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পুরসভায় এই ভাঙচুরের ঘটনার আমরা নিন্দা করছি। ওই আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও যোগ নেই। রাজনৈতিক কারণেই মিথ্যা অভিযোগ করছে তৃণমূল।” অভিযুক্ত অশোকবাবু দাবি করেছেন, “আমি মোটরবাইক নিয়ে মাচানতলা দিয়ে যাওয়ার সময় অবরোধের মধ্যে পড়ে আটকে যাই। কিন্তু হামলায় মিথ্যা আমাকে জড়ানো হয়েছে। আমি ওই হামলা কোনও ভাবেই সমর্থন করি না।’’
ঘটনা হল, গত কয়েক দিন ধরেই বাঁকুড়া পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ইদগা মহল্লায় বেশ কিছু মানুষ ডায়েরিয়ায় অসুস্থ হচ্ছেন। রবিবার ওই এলাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতা শিবিরও করে পুরসভা। সেই রাতেই এলাকার বধূ বেবি বেগমের মৃত্যু হয়। মৃতার পরিবারের তরফে দাবি করা হয়, ডায়েরিয়াতেই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও ওই বধূকে হাসপাতালে ভর্তি না করানোয় সরকারি ভাবে তাঁর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাচ্ছে না। তবে এই ঘটনার পর সোমবার বিকেলেই জেলা স্বাস্থ্য দফতর ওই এলাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করে। রাতেই সেই শিবির অবশ্য তুলে নেওয়া হয়।
মঙ্গলবার বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা নাগাদ ইদগা মহল্লার লোকজন পুরভবন লাগোয়া মাচানতলা মোড়ে পথঅবরোধ শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ, ডায়েরিয়া এলাকায় ক্রমশ ছড়াচ্ছে। অথচ স্থায়ী স্বাস্থ্য শিবির হচ্ছে না এলাকায়। অসুস্থাদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভর্তিও নেওয়া হচ্ছে না। এলাকাবাসীর দাবি, পুরসভার জলই দূষিত হয়ে পড়েছে। তা থেকেই ডায়েরিয়া ছড়াচ্ছে এলাকায়।
অবরোধের শুরু থেকেই আন্দোলনকারীরা আক্রমণাত্মক ছিল। মাচানতলা মোড়ের একাংশ বাঁশ দিয়ে আগেই আটকে দেওয়া হয়। অন্য অংশে হাত ধরে ব্যারিকেড করে তোলেন এলাকার বধূরা। সাইকেল, মোটরবাইক তো দূর, এই তীব্র গরমে সাধারণ পথচারীদেরও পার হতে দেয়নি তারা। কেউ ব্যারিকেড টপকে রাস্তা পার হতে গেলে কড়া ধমক দিয়ে অন্য রাস্তা ধরতে বলে আন্দোলনকারীরা। পুলিশ অবরোধ তুলতে গেলে, তাদের সঙ্গে বচসা জুড়ে দেয় অবরোধকারীরা। এরই মধ্যে উত্তেজিত জনতার একটা অংশ পুরভবনে ঢুকে পড়ে।
সামনে পুরপ্রধানের গাড়ি দেখতে পেয়ে সামনের কাঁচ ভেঙে দেয় তারা। পুরভবন চত্বরের সাইকেল, মোটরবাইক উল্টে দিয়ে জলকল দফতর ও অর্থ দফতরে ঢুকে পড়ে হইচই জুড়ে দেয় তারা। সেখানে চেয়ার, টেবিল উল্টে দেওয়া হয়। কর্মীদেরও হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ। অবিলম্বে এলাকায় স্বাস্থ্য শিবির চালু করতে হবে বলে দাবি তোলে আন্দোলনকারীরা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই তাণ্ডব চলার পর জেলা স্বাস্থ্য দফতরের একটি দল এলাকায় গেলে উত্তেজনা থিকিয়ে যায়। অবরোধও ওঠে। পরে সিসিটিভি-র ফুটেজ খতিয়ে দেখে ভাঙচুরকারীদের শনাক্তও করা হয়। পুরভবনে গিয়ে পুরপ্রধানের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ নেয় পুলিশ।দোষীদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি তুলেছে পুরকর্তৃপক্ষ। এ দিন বিকেল পর্যন্ত অবশ্য এই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি।
ইদগা মহল্লা এলাকায় কেন ডায়েরিয়া ছড়াচ্ছে তার সদুত্তর অবশ্য নেই প্রশাসনের কাছে। এলাকাবাসী এ জন্য পানীয় জলে কোনও ভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে বলে দাবি করছেন। যদিও পুরপ্রধানের যুক্তি, “১২ নম্বর ওয়ার্ড অনেক বড় এলাকা। জল থেকেই যদি পেটের অসুখ ছড়াত তাহলে কেন শুধু একটা মহল্লাতেই এই ঘটনা ঘটবে? ওয়ার্ডের আর কোনও এলাকায় তো ডায়েরিয়া হচ্ছে না!” জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রসূন দাস বলেন, “আমরা ওই এলাকার জলের নমুনা সংগ্রহ করেছি। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পরেই জলের কোনও সমস্যা রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে পারব। অসুস্থদের বমি ও পায়খানার নমুনাও সংগ্রহ করা হবে।” এলাকায় স্থায়ী স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করা হচ্ছে না কেন, তার জবাবে প্রসূনবাবু বলেন, “ওই এলাকায় আগামী কয়েক দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির করার সিদ্ধান্ত আমরা আগেই নিয়েছি। সোমবারও সেই শিবির ছিল। আগামী কয়েক দিনও থাকবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy